ওপারে কুড়িগ্রামের চিলমারী, এ পারে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ এবং মাঝপথ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে দেড় কিলোমিটার প্রশস্ত তিস্তা নদী। বর্ষা এলেই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে এ নদী। ভেঙে তছনছ করে একের পর এক বসতভিটা ও ফসলি মাঠ। নিঃস্ব হয়ে পড়ে এ জনপদের মানুষ। দুই উপজেলার লাখ লাখ মানুষের পারাপারের একমাত্র উপায় ছিল খেয়া। দিনে খেয়াতে নদী পাড়ি দিতে পারলেও সন্ধ্যে নেমে এলেই বন্ধ হয়ে যেত সেই খেয়া। দূরত্ব মাত্র দেড় কিলোমিটার হলেও দেরি কিংবা যে কোনো কারণে খেয়া ধরতে না পারলে উপোষ করে রাত কাটাতে হতো নদী পাড়ি দিতে না পারা অপেক্ষারত মানুষদের। রাত পোহালে তবেই হতো বাড়ি ফেরা।
দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে এখন বাস্তব রূপ নিতে যাচ্ছে সেই স্বপ্নের তিস্তা সেতু। ইতোমধ্যে প্রায় ৭৫ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে নির্মাণ কাজ। যুগযুগ ধরে যাতায়াতের সেই দুর্ভোগ নিরসনে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে নির্মিত হচ্ছে এক দশমিক ৪৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে স্বপ্নের তিস্তা সেতু। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে কুড়িগ্রাম, উলিপুর, নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী ও চিলমারী থেকে সড়কপথে ঢাকার দূরত্ব কমে আসবে প্রায় ১০০ কিলোমিটার। দূরত্ব কমবে বিভাগীয় শহর রংপুরেরও। এতে বাঁচবে সময় ও অর্থ। পাল্টে যাবে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান। ঘুচবে দুঃখ এবং ঘটবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই সেতুটিকে ঘিরে প্রায় ৮০ কিলোমিটার অ্যাকসেস সড়ক উন্নয়ন, সংশ্লিষ্ট সড়কে ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ, মাটির কাজ এবং জমি অধিগ্রহণসহ গোটা প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৮৫ কোটি টাকা। ৩১ স্প্যান বিশিষ্ট মূল সেতুর নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় সেতুর দুই পাশে নদী শাসনের কাজ, এপার্টমেন্ট নির্মাণ, ৩০টি পিলার ও ১৫৫টি গার্ডার স্থাপন কাজ করা হচ্ছে।
সৌদি সরকারের অর্থায়নে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর খেয়াঘাট এলাকায় এক হাজার ৪৯০ মিটার (প্রায় দেড় কিলোমিটার) দীর্ঘ ও ৯.৬ মিটার প্রস্থ এই সেতুটির নির্মাণ কাজের দায়িত্ব পেয়েছে চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। দু’পাশে এক কিলোমিটার করে অ্যাপ্রোচ সড়কসহ মূল সেতুটি নির্মাণে ব্যয় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩৬৭ কোটি ৯৮ লাখ ১৩ হাজার টাকা।
সেতু পয়েন্ট থেকে বেলকা বাজার হয়ে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা সদর, পাঁচপীর বাজার এবং পাঁচপীর বাজার থেকে ধর্মপুর হয়ে গাইবান্ধা সদর উপজেলার হাটলক্ষীপুর বাজার থেকে সাদুল্লাপুর উপজেলা শহর হয়ে ধাপেরহাট গিয়ে রংপুর-ঢাকা মহাসড়কে সংযোগ। সুন্দরগঞ্জের শোভাগঞ্জ বাজার থেকে পাঁচপীর বাজার পয়েন্ট, মাঠেরহাট থেকে বড়ুয়াহাট ওয়াপদা বাঁধ, মাঠেরহাট থেকে সদর উপজেলার কামারজানি বন্দর সড়কের উন্নয়ন কাজ।
এসব সড়ক ১৮ মিটার প্রশস্তে উন্নীত করা হচ্ছে। এজন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এই সড়কগুলোতে নতুন করে ৫৮টি বক্স কালভার্ট এবং ৯টি আরসিসি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৯৬ মিটার দীর্ঘ একটি, ৪৮ মিটার দীর্ঘ দুটি, ২০ মিটার দীর্ঘ দুটি, ১৬ মিটার দীর্ঘ একটি এবং ১২ মিটার দীর্ঘ ৩টি সেতুর নির্মাণের কাজ চলছে।
সেতুটি নির্মাণ কাজ শেষ হলে কুড়িগ্রামের চিলমারী, উলিপুরসহ ৫টি উপজেলা এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, সাদুল্লাপুর ও সদর উপজেলার লাখ লাখ মানুষের রাজধানীসহ পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াত এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষি পণ্য এবং অন্যান্য সামগ্রী সরাসরি বাজার জাতের দ্বার উন্মোচিত হবে।
এ বিষয়ে এলজিইডির গাইবান্ধার নির্বাহী প্রকৌশলী ছাবিউল ইসলাম মুঠোফোনে জানান, তিস্তা সেতুসহ গোটা প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন। সে অনুযায়ী কাজ চলছে। পাইলিং কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। মূল সেতুর ৩০টি পিলারসহ ক্যাপ স্থাপন, ১৫৫টি গার্ডারের মধ্যে ৭৫টির সংযোজন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকিগুলোরও কাজ চলছে। অপরদিকে ৩১টি স্প্যানের মধ্যে ১৪টি স্প্যান স্থাপনের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে।