গত আড়াই মাসে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ২১ শিক্ষার্থীর অকাল মৃত্যু হয়েছে। এই তরুণ প্রাণগুলো হারিয়ে গেছে কখনো সাগরের স্রোতে, কখনো একাকীত্বের আঁধারে, কখনো বা অন্যের হিংস্রতার শিকার হয়ে।
কারও মৃত্যুর পেছনে ছিল শারীরিক অসুস্থতা, কেউ চরম হতাশায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন, আবার কেউ দুর্ঘটনা বা খুনের শিকার হয়েছেন।
সবশেষ কক্সবাজারের হিমছড়ি সৈকতে গোসলে নেমে স্রোতে ভেসে যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী—অরিত্র হাসান, কে এম সাদমান রহমান ও আসিফ আহমেদ।
এই ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম নয়। চলতি বছরের এপ্রিলের শেষ দিক থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়েই ২১ শিক্ষার্থীর প্রাণ চলে গেছে। যাদের কেউ কেউ ছিলেন মেধাবী, কিছুদিন আগেও বন্ধুদের মাঝে প্রাণবন্ত, স্বপ্নে ভরা মুখ।
এই মৃত্যুর মিছিলে আত্মহত্যা করেছে ৫ জন, ৩ জন মারা গেছেন শারীরিক অসুস্থতায়, আর ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে দুর্ঘটনা ও নির্মম সহিংসতায়। আত্মহত্যার ঘটনাগুলোর পেছনে উঠে এসেছে সম্পর্ক ভাঙন, মানসিক চাপ এবং একাকীত্বের কথা।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র তারেক ওয়াদুদের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার হয় স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের দুই দিন পর।
ঢাবির চারুকলার শিক্ষার্থী শাকিল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্রুব, বেগম রোকেয়ার টুম্পা, ইস্ট ওয়েস্টের শিহাব—তারা কেউই হয়তো মনে করেননি, কেউ তাদের অনুভূতি বোঝার জন্য আছে।
শারীরিক অসুস্থতায় প্রাণ হারিয়েছে তিনজন শিক্ষার্থী—চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সানজিদা টিবিতে, ঢাবির আহসান মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে, আর জাহাঙ্গীরনগরের জোবায়ের হিমোফিলিয়ায়।
দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে অনেকেই হারিয়েছেন প্রাণ গোসলে নেমে বা সড়ক দুর্ঘটনায়। হঠাৎ বজ্রপাত, মোটরসাইকেলের বিস্ফোরণ বা পানিতে ডুবে—সবই যেন অকস্মাৎ থেমে যাওয়া একটি স্বপ্নের নাম।
তিনটি হত্যাকাণ্ডও কাঁপিয়ে দিয়েছে গোটা শিক্ষাঙ্গন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছুরিকাঘাতে খুন হন ঢাবির ছাত্রদল নেতা সাম্য, বনানীতে প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পারভেজকে হত্যা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই।
চারদিন নিখোঁজ থাকার পর মেট্রোরেল লাইনের পাশ থেকে মাহমুদুল হাসানের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার হয়, যা এখনও রহস্যময়।
এভাবে একের পর এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু শুধু পরিবার নয়, গোটা সমাজকে নাড়া দিয়েছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নূর মোহাম্মদ বলছেন, “শিক্ষার্থীরা অনেক সময় নিজেদের ভেতরে জমে থাকা যন্ত্রণা বা হতাশা প্রকাশ করতে পারে না।
তাই মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এখনই সচেতনতা বাড়াতে হবে। শিক্ষকদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও হতে হবে আরও যত্নবান ও সহানুভূতিশীল।”
এই মৃত্যুগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে—শুধু একাডেমিক সাফল্য নয়, শিক্ষার্থীদের মানসিক নিরাপত্তা, ভালোবাসা ও সহানুভূতির পরিবেশ নিশ্চিত করাও সময়ের দাবি।
তরুণদের এই হারিয়ে যাওয়া যেন কেবল সংখ্যা নয়—প্রতিটি মৃত্যু একেকটি পরিবারের ভাঙা স্বপ্ন, একেকটি সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি। এখনই প্রয়োজন সকলের সম্মিলিত দায়িত্ববোধ ও কার্যকর উদ্যোগ। যেন ভবিষ্যতে আর কোনো স্বপ্ন থেমে না যায় মাঝপথে।