রাজনৈতিক অস্থিরতা, শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট, ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি, পণ্য আমদানিতে উচ্চ শুল্ক, ঋণের উচ্চ সুদহার, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে স্বল্পতা প্রভৃতি কারণে সংকটের মুখে দেশের অর্থনীতি। এছাড়া আশানুরূপ বাড়ছে না বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও রাজস্ব আদায়। নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান নেই। অর্থনীতির এ ভঙ্গুরতা থেকে বেরিয়ে আসার সুনির্দিষ্ট কোনো রোডম্যাপও নেই। এ পরিস্থিতিতে স্বল্পোন্নত দেশে (এলডিসি) উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
ব্যবসায়ীদের মতে, এটি উন্নয়নযাত্রার একটি মাইলফলক হলেও নানা চ্যালেঞ্জও তৈরি করবে। রপ্তানি খাতে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি হারানো এবং বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে বাংলাদেশকে।
পরিকল্পনা বিভাগের একটি সমীক্ষা অনুসারে, এলডিসি উত্তরণের পর শুল্কমুক্ত সুবিধা হাতছাড়া হওয়ার কারণে আনুমানিক সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এলডিসির স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজি বিষয়ে এসএসজিপির কম্পোনেন্ট ম্যানেজার ড. মোস্তফা আবিদ খান জানান, বাংলাদেশ মোট রপ্তানির প্রায় ৭৩ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে থাকে, যা এলডিসি-পরবর্তী সময়ে পাওয়া যাবে না। তাছাড়া বেশকিছু প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হতে হবে।
জানতে চাইলে বিকেএমইএ এবং বাংলাদেশ রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, ‘দুদিন ধরে আলোচনা চলছে এলডিসি উত্তরণের সময় পিছিয়ে দেওয়ার। এর আগে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছিলেন, এলডিসি উত্তরণ নিয়ে আমরা টেপে পড়ছি। প্রত্যেকেই বলছেন আমরা এখন এলডিসি উত্তরণে যাওয়ার মতো অবস্থানে নেই। শ্বেতপত্র প্রণয়নকারী অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যও আমাকে বলেছেন, সরকার পরিবর্তনসহ কয়েকটি কারণে বিশ্বের কয়েকটি দেশ এলডিসি উত্তরণে গিয়েও আবার ফেরত আসছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিগত সরকারের দেওয়া সূচকের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এলডিসি উত্তরণের পথ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সে তথ্যগুলো ভুল প্রমাণ হয়েছে। ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যে লক্ষ্যমাত্রা নিরূপণ করা হয়েছিল, সেটি সংশোধন করে নতুন রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে সময় প্রয়োজন হলে তা দিতে হবে। এরপরও যদিও ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি উত্তরণে যেতে বাধ্য করা হয়, তাহলে সেটি হবে পরিকল্পিতভাবে জেনেশুনে আত্মহত্যার প্রস্তুতি।’
সংশ্লিষ্টদের মতে, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শুরু থেকেই যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ঘাটতি ছিল। শুধু রাজনৈতিক বাহাবা নেওয়ার জন্য এটি করা হয়েছে। বেসরকারি খাতের মতামতের ভিত্তিতে কতটুকু টেকসই উপায়ে এলডিসি উত্তরণ প্রক্রিয়াকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া যায়, সে ব্যাপারে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যে কারণে তৈরি পোশাক খাতের পণ্যের বহুমুখীকরণের পাশাপাশি প্যাকেজিং খাতের উন্নয়নে মনোযোগী দেখা যায়নি।
এলডিসি উত্তরণের পর নগদ সহায়তার বিকল্প হিসাবে সরকার কী কী সুবিধা দেবে, রপ্তানি খাতে বিদ্যুৎ বিলে যে রেয়াত দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, ডব্লিউটিওর (বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা) নিয়মানুযায়ী তা আদৌ দেওয়া সম্ভব হবে কি না-সেটাও অনিশ্চিত। ফলে শিল্পের মালিকদের বড় ধরনের চাপের মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ইতোমধ্যে যেসব দেশ এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেছে, তাদের কারও মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশ একটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। ফলে ওইসব দেশের হারানোর কিছু নেই; যেটা বাংলাদেশের আছে। নেপাল স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে গেছে; কিন্তু তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। ফলে তাদের এ রিজার্ভ কোথায় কাজে লাগাবে, সেটি খুঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু ২০১৮ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করার সময় রিজার্ভ ছিল ৪৫ বিলিয়ন ডলার, যা এখন ১৮ বিলিয়ন ডলারে ঘুরপাক খাচ্ছে। অর্থনীতির অন্যান্য সূচকও নিম্নমুখী।
এছাড়াও তৈরি পোশাক খাতের বাইরে রপ্তানির সম্ভাবনাময় অন্যান্য খাত যেমন: ওষুধ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, সেমিকন্ডাক্টর, হালকা প্রকৌশল এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে রপ্তানি বাড়াতে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়নি।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) এক গবেষণার তথ্যমতে, বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে পরবর্তী ধাপে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এরকম অবস্থায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে ভিয়েতনাম মুক্তবাণিজ্য চুক্তিতে সই করেছে। এ দুটি ঘটনার সম্মিলিত প্রভাবে ইইউ-এর বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি ২১ দশমিক ২ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। আবার এ রপ্তানি কমার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ কমার আশঙ্কা রয়েছে।
সেখানে আরও বলা হয়, এফটিএ-এর কারণে ইইউতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ভিয়েতনামের ওপর থেকে ধারাবাহিকভাবে শুল্ক ওঠে যাচ্ছে, আরেকদিকে এলডিসি উত্তরণের কারণে বাংলাদেশের পণ্যে শুল্ক বাড়বে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যুক্ত হলেও পরের তিন বছর ইইউ-এর বাজারে এ সুবিধা থাকবে। তারপর কিন্তু শুল্ক দিতে হবে। এ দুটি বাস্তবতাই উদ্বেগজনক এ কারণে যে, বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ৪৮ শতাংশের গন্তব্য ইইউ।
২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের পর রপ্তানির বিপরীতে নগদ প্রণোদনা দেওয়া যাবে না। এর প্রভাবে চামড়া ও চামড়াজত পণ্য, পাটজাত পণ্য, কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য এবং ওষুধ খাতের রপ্তানি সক্ষমতা হারানোর শঙ্কা রয়েছে। যদিও কী ধরনের বিকল্প সুবিধা দেওয়া যায়, তা পর্যালোচনায় সম্প্রতি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।