আমাদের দেশের ব্যক্তি মালিকানাধীন বাস পরিবহণ খাত থেকে শুরু করে বিগত দিনে যেন অনিয়ম-দুর্নীতির মহোৎসব হয়েছে। এদিকে পরিবহণ খাতে যেন আপাদমস্তক অনিয়ম-দুর্নীতিতে জর্জরিত। তবে এর পেছনে রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতায় বলীয়ান মালিক ও শ্রমিকদের সংগঠনের আঁতাত ছিল বলে ধারণা করা হয়েছে। এখানে অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে আইন ও নিয়মনীতি বাস্তবায়ন করেও যাত্রীরা তেমন প্রত্যাশিত সেবা পায়নি।
অন্যদিকে সাধারণ শ্রমিকরাও ন্যায্য দাবি থেকে বঞ্চিত হয়েছে দিনের পর দিন। বিশেষ করে বাস কোম্পানিগুলোকে অনানুষ্ঠানিক নিয়োগ বন্ধ করে শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী কর্মী নিয়োগ ও প্রয়োজনীয় নীতিমালা (অর্থ ও প্রশাসন, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, জেন্ডার, অভিযোগ গ্রহণ ও নিরসন, তথ্য উম্মুক্তকরণ, ক্রয় ও টিকেট ইত্যাদি) প্রণয়ন ও তা তদারকির আওতায় আনা জরুরি। এছাড়াও জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ও সব ধরনের প্রভাবমুক্ত হয়ে সড়ক পরিবহণ আইন ২০১৮ এর পূর্ণাঙ্গ আইন বাস্তবায়ন হয়নি। তবে সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮ এর কিছু সংশোধন ও সংযোজন সাপেক্ষে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্পোরেশন আইন-২০২০ করা হয়েছে। এ আইন বাস্তবায়ন হলে পরিবহণ সেক্টরে আমূল পরিবর্তন আসবে।
বাংলাদেশের বাস কোম্পানির প্রায় ৯২ শতাংশ মালিক ও পরিচালনা পর্যদের সংশ্লিষ্টরা রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ততা রয়েছে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই আওয়ামী লীগ সরকারের দলীয় নেতা-কর্মী ও বাকি ১২ শতাংশ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অনুসারী এর সাথে জড়িত। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ নারী যাত্রী বাসে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। এছাড়াও ২২ শতাংশ শ্রমিক মাদক বা নেশা করে গাড়ি চালনোর কারণে বিভিন্ন সময়ে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে টিআইবির এক প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগ সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও সিন্ডিকেটের কাছে এ জনগুরুত্বপূর্ণ যাত্রীবান্ধব গণপরিবহণ খাতটিকে জিম্মি করে আসছে। আর বাস পরিবহণ ব্যবসায় বিভিন্ন আঙ্গিকে চাঁদাবাজি ও অবৈধ লেনদেন করে আসছে এতদিন। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমাবেশ, বিভিন্ন দিবস পালন, টার্মিনালের বাইরে পার্কিং, সড়কের বিভিন্ন স্থানে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন ও টোকেন বাণিজ্যের মাধ্যমে বাস মালিক এবং কর্মী-শ্রমিকরা চাঁদা দিতে বাধ্য হয়েছে। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ হলো গাড়ির নিবন্ধন ও সনদ এবং হালনাগাদ বাবদ ঘুষ দিতে হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সূত্রে জানা যায় যে, বিদেশে আত্নগোপনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা গত ১০ বছর ধরে স্থানীয় ছোট ছোট চাঁদাবাজ গ্রুপগুলোকে দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজি করে আসছে। কিন্তু তারা দেশে না থাকলেও তাদের নামে চাঁদাবাজি এখনও কিন্তু থেমে নেই। আর শীর্ষ সন্ত্রাসীরা রাজধানীর ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জ ও কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে পুলিশ সদস্যদের সহযোগিতায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বন্দীশালায় থেকেও মোবাইল ও লেপটপ ব্যবহার করে সহজেই তাদের নেটওয়ার্ক চালিয়ে যাচ্ছে।
তথাপি কারাগারে বন্দিশালা থেকেও আন্ডারওয়ার্ল্ডে তাদের আধিপত্য এখনও কমেনি। বরং দিন দিন বাড়ছে তাদের সস্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। অর্থাৎ শীর্ষ সস্ত্রাসীরা কারাগারে বসে মোবাইল ফোনে হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজি করে বলে জানা যায়। অন্যদিকে কিছু অসাধু মোবাইল সীম কার্ড ব্যবসায়ীদের সহযোগীতায় সন্ত্রাসীরা অবৈধ মোবাইলের সীম কার্ডের মাধ্যমেও চাঁদাবাজি করে আসছে বছর পর বছর। বিশেষত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অনেক অবৈধ সীম কার্ড ব্লক করে দেয়ার পরও চাঁদাবাজি কমছে না। অথচ এ অবৈধ ও বেনামী মোবাইলের সীম কার্ডের কারণে অনেক সময় পুলিশ কিন্তু চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করতে পারচ্ছে না। বিশেষ করে রাজধানীসহ সারা দেশে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরেই চাঁদাবাজি করে আসছে একশ্রেণি দুর্বৃত্তরা। এর সাথে দেশের বেশ কয়েকটি কুরিয়ার সার্ভিস ও এসএ পরিবহণসহ চাঁদাবাজি চক্রের সাথে জড়িত রয়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানায় যায়। তবে আওয়ামী লীগের কিছু রাজনৈতিক নেতাদের সহযোগিতায় সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন স্থান থেকে মাসোহোরা চাঁদা বাবদ কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আর এ চাঁদার ভাগ কতিপয় একশ্রেণি অসাধু ব্যক্তিরা যেমন-আওয়ামী লীগ সরকারের দলীয় পরিচয়কারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ, বিআরটিএর কর্মকর্তা-কর্মচারি, মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশনের প্রতিনিধিসহ অন্যরা নিয়মিত পেয়ে থাকে। এসব তথ্য টিআইবির এক গবেষণায় ওঠে এসেছে।
অন্যদিকে এক সংবাদ সম্মেলনে ‘ব্যক্তি মালিকানাধীন বাস পরিবহণ ব্যবসায় শুদ্ধাচার’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, চাঁদাবাজির হিসাব খুবই রক্ষণশীল হিসাব। তবে বাস্তবে এর চেয়ে বহুগুণ বেশি চাঁদাবাজি হয় আর এ চাঁদার ভাগ নানা পর্যায়ে যায়। অর্থাৎ এ খাতটি যেহেতু রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণে সেহেতু চাঁদার নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে বলা যায়। এছাড়াও বিভিন্ন দিবস ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের নামে দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের বেপরোয়া এ চাঁদাবাজি অনেকটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। এতে বলা হচ্ছে, স্থানীয় পর্যায়ে বেসরকারি চাঁদা বা অনুদানের অর্থে এলআর ফাণ্ড গঠন করা হয়। যা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য এ তহবিল থেকে আপ্যায়ন বাবদ ব্যয় করা হয়। বিশেষ করে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অধীনে এ তহবিল পরিচালিত হয়। ২০১৬ সালের অক্টোবরে জাতীয় সংসদে একটি বিল পাশের সময় বক্তব্যে সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী এ তহবিলকে চাঁদাবাজি বলে মন্তব্য করেন। এ প্রসঙ্গে টিআইবির পরিচালক বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে এলআর ফাণ্ড গঠনের উদ্দেশ্য মহৎ ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে এ তহবিল ঘিরে ব্যাপক চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। যা খুবই উদ্বেগজনক। এটা প্রশাসনের জন্য আত্নঘাতীমূলক। এর কারণ কিছু সংখ্যক কর্মকর্তার অপকর্মের দায় পুরো প্রশাসনের উপর বর্তায়। যা প্রশাসনিক কাঠামোর উপর মানুষের আস্থা সংকট কিন্তু ঘনীভূত হচ্ছে।
আর গণতান্ত্রিক দেশে এ ধরনের চাঁদাবাজি গ্রহণযোগ্য নয়। উল্লেখ্য যে, বিভিন্ন উৎসব ও দিবসে মোবাইল কোর্টের তৎপরতা বেড়ে যায়। এর কারণ রেস্তোরাঁর মালিক, পেট্রোল পাম্প, মজুতদার ও সরকার বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে উক্ত উৎসব ও দিবসকে ঘিরে টার্গেট করে চাঁদাবাজি করে আসছে। আর এসব চাঁদাবাজির বিষয়ে সরকার ও প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের সবাই অবগত আছেন বলে সুশীল সমাজ দাবি করছে। তবুও কেন এর কোনো প্রতিকার নেই। বিশেষ করে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলার সকল ষ্ট্যান্ডে টেম্পু-অটোরিকশা ও পিকআপ ভ্যানে জিপির নামে চাঁদা আদায় করে। এছাড়াও ঈদ ঘনিয়ে এলেই বকশিস ও আবদারের ছলে এ চাঁদাবাজি চলে দেদারছে। দেশের বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কাষ্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট, ইনকাম ট্যাক্স, বিদ্যুৎ ও গ্যাস এবং ওয়াসা বিভাগে কর্মরত একশ্রেণি অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে এলাকাভিত্তিক সাধারণ মানুষের কাছে থেকে অবৈধভাবে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আসছে। বিশেষত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অন্ত্রধারী চাঁদাবাজ গ্রুপের দৌরাত্নের বেশ কয়েকটি ঘটনার সিসি ক্যামরার ফুটেজ প্রকাশ পেলেও পুলিশ বেশির ভাগ সন্ত্রাসীকে শনাক্ত করতে পারেনি। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, সারা দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কিছু অসৎ লোকের ক্ষমতার বাড়াবাড়ি, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে মানুষ ছিল অসহায়। এ সুবাধে কেউ কেউ অন্যায় ও অবৈধভাবে টাকার পাহাড় গড়ছে। আর এ অর্থ আবার বিদেশে পাচার করেছে। অথচ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর কোনো ব্যবস্থা নেইনি। তবে এ বিষয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকারের উচিত কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে চাঁদাবাজ যে দলেরই হোক না কেন? তাদেরকে এ বাংলার মাটিতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সুশীল সমাজ তাই মনে করেন।
উল্লেখ্য যে, বর্তমানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নানামুখী উদ্যোগের কারণে ঢাকাসহ দেশের মহাসড়কগুলোতে চাঁদাবাজি কিছুটা কমে আসছে বলে জানা যায়। এদিকে পুলিশের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, পণ্য পরিবহণসহ কোনো সেক্টরে কোনো ধরনের চাঁদাবাজি বরদাশত করা হবে না। এক্ষেত্রে সকল ধরনের চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিশেষত পুলিশ হেড কোয়ার্টারে বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা, নিরপত্তা এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সভায় তিনি বলেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ যদি এ ধরনের চাঁদাবাজির সাথে জড়িত থাকে। সেক্ষেত্রে তাদের কঠোরতর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। ইতিমধ্যে পুলিশের কিছু সদস্যদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও মানুষ হত্যার মতো ঘটনা প্রমাণিত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিসহ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। আমাদের দেশের গণমাধ্যমকে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। আর দেশের সব সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলকে দলনিরপেক্ষ হতে হবে। বিশেষত রাজনৈতিক প্রভাব বা অন্য কোনো প্রভাবে বিচার ব্যবস্থাকে যেন প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারে। সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তাছাড়া অসৎ নেতাদের সাংগঠনিক কাঠোমো থেকে বাদ দিয়ে যোগ্য আর সৎ ও ত্যাগী কর্মীসহ দেশের তরুণ সমাজকে নিয়ে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। তবেই এ দেশ চাদাঁবাজি মুক্ত হবে।
লেখক: ড. মোঃ রফিকুল ইসলাম, গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চট্রগ্রাম