জনপ্রশাসনের দলবাজ ও দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাদের এখন কী হবে- এমন প্রশ্ন সর্বত্র জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। ১৬ বছরে যেসব যোগ্য ও মেধাবী কর্মকর্তাকে যারা প্রতিপক্ষ হিসাবে চিহ্নিত করে প্রাপ্য পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করেছেন, বছরের পর বছর ওএসডি রেখেছেন এবং নানাভাবে হয়রানি ও জুলুম করেছেন, তাদেরকে দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করার দাবি তুলেছেন ভুক্তভোগী কর্মকর্র্তারা।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সোমবার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার পর এ প্রতিবেদকের কাছে প্রশাসনের নানা স্তর থেকে ভুক্তভোগী কর্মকর্তারা ফোন করেন। প্রশাসন ক্যাডারের বিভিন্ন ব্যাচের ক্ষতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের দাবি-তাদের পদোন্নতিবঞ্চিত করাসহ নানাভাবে হয়রানি করার পেছনে প্রথমত দায়ী একশ্রেণির দলবাজ ও দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা। তারা সবাই চিহ্নিত। আগে তাদের প্রশাসন থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করতে হবে। এরপর জনতার মুখোমুখি করে তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
ভুক্তভোগী কর্মকর্তারা বলেন, এরকম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি শুধু প্রশাসন ক্যাডারে নয়, পুলিশ ক্যাডারসহ প্রতিটি ক্যাডার ও নন-ক্যাডার মিলে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দলীয়করণের বিষবৃক্ষ বপন করা হয়েছিল। একশ্রেণির সুবিধভোগী ও নব্য আওয়ামী লীগধারী কর্মকর্তাদের অত্যাচারে প্রশাসনের হাজার হাজার কর্মকর্তা ১৬ বছরে সীমাহীন জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তারা বলেন, এ পর্যন্ত এসএসবির (সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড) বৈঠকে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের কোনো ক্ষমা নেই। পদোন্নতিবঞ্চিত করার জন্য প্রথমত দায় তাদের। এছাড়া প্রতিটি ব্যাচে একশ্রেণির আওয়ামী দালাল ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তরা পদোন্নতিসহ গুরুত্বপূর্ণ পদায়ন নিয়ন্ত্রণ করেছেন। যারা একেকজন শোষকের মতো ভূমিকায় ছিলেন। তাদের কারও ক্ষমা হবে না।
আওয়ামী নামধারী দালাল ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বেশির ভাগ বিদেশে শত শত কোটি টাকা পাচার করেছেন। সন্তানদের বিদেশে পড়াশোনা করানোসহ রাজসিক আরাম-আয়েশে রেখেছেন। কেউ কেউ আগে সন্তানদের পুনর্বাসন করেছেন; এরপর প্রায় প্রত্যেকে সে দেশে বাড়ি, গাড়ি ও ফ্ল্যাট কিনে গোপনে দ্বিতীয় নাগরিকত্ব নিয়েছেন। প্রতিটি ব্যাচের এরকম দুর্বৃত্তদের সংখ্যা কম নয়। তারা দাবি করেন, তাদের মধ্যে কেউ যেন দেশ থেকে পালাতে না পারেন। আর যারা বিদেশে পালিয়ে গেছেন, তাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে।
ভুক্তভোগী কর্মকর্তাদের অনেকে উপসচিব হিসাবে চাকরি শেষ করেছেন। অথচ নিজ যোগ্যতাবলে যাদের অনেকের সচিব হওয়ার কথা ছিল। প্রতিপক্ষ হিসাবে চিহ্নিত হওয়া কোনো কোনো কর্মকর্তা নানা চেষ্টা-তদবির করে ভাগ্যগুণে যুগ্মসচিব কিংবা বড়জোর অতিরিক্ত সচিব হতে পেরেছেন। পুলিশেও একই অবস্থা। এছাড়া সবচেয়ে বেদনার বিষয় হলো-অনেককে জুনিয়র কর্মকর্তার অধীনে চাকরি করতে বাধ্য করা হয়েছে। হয়তো যে কর্মকর্তার বস হিসাবে যিনি এসিআর দিয়েছেন, সেই কর্মকর্তার অধীনেই তাকে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। রেলভবনে জুনিয়রের অধীনে পদায়নের মুখোমুখি হওয়া উপসচিব সুরাইয়া আখতার জাহান যুগান্তরকে জানান, তিনি মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে বাধ্য হয়ে একপর্যায়ে অনেক চেষ্টা-তদবির করে পরমাণু শক্তি কমিশনে পোস্টিং নিয়েছেন। ১৮ ব্যাচের এ কর্মকর্তা যুগ্মসচিব পদে চারবার পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন। অথচ তার ব্যাচের অনেকে এখন অতিরিক্ত সচিব।
প্রশাসনের বেশির ভাগ কর্মকর্তা বলেন, অভিযুক্তদের শুধু চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া কোনো সমাধান নয়, তাদের প্রত্যেককে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ প্রশাসনের ওপর দলবাজির স্টিম রুলার চালাতে না পারে। প্রশাসন যেন দলমতনিরপেক্ষ মেধাবী কর্মকর্তাদের জন্য স্বর্গভূমি হয়, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা প্রশাসনে আর কোনো দলবাজি বা দলীয়করণ দেখতে চাই না। প্রশাসন এখন আবার বিএনপি ও জামায়াতপন্থিদের দখলে চলে যাক, সেটিও আমরা চাই না। প্রশাসন চলবে সংবিধান ও আইন মেনে। কোনো সরকারি কর্মকর্তা যেন রাজনীতি করতে না পারে, সে পথ চিরতরে রুদ্ধ করে দিতে হবে। এমনকি কেউ কোনো প্রকার রাজনৈতিক বক্তব্যও দিতে পারবে না। সবাইকে কর্মচারী আচরণবিধি মেনে চলতে হবে। প্রতিবছর পৃথকভাবে সম্পদবিবরণী জমা দিতে হবে।
এদিকে সচিবালয়ে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কয়েকটি সূত্র জানায়, শুধু ক্যাডার কর্মকর্তা নন, নন-ক্যাডার ও সাধারণ কর্মচারীদের মধ্যে যারা বিগত সময়ে চরমমাত্রায় ও প্রকাশ্যে দলবাজি করেছেন, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে সচিবালয় সমবায় সমিতি ঘিরে প্রশাসনিক কর্মকর্তা রুহুল আমীনের নেতৃত্বে যারা সমিতির টাকা লুটপাট করেছেন, তাদেরকে কোনোভাবে ছাড়া যাবে না। তারা যেন দেশ থেকে পালাতে না পারেন, সেই ব্যবস্থা এখনই নিতে হবে। সচিবালয় সমবায় সমিতির অর্থ যারা তছরূপ করে নিজেরা ফুলেফেঁপে উঠেছেন, তাদের তদন্তের আওতায় নিয়ে বিচার করার জোরালো দাবি জানানো হয়। তারা বলেন, তারা শুধু কর্মচারীদের হয়রানি করেই ক্ষান্ত হননি, বহু ক্যাডার কর্মকর্তাকে বিএনপি ও জামায়াতপন্থি ট্যাগ লাগিয়ে হেনস্তা করেছেন।
চাকরি থেকে অবসরে যাওয়া এবং চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে ১৯৮৪ ব্যাচের যুগ্মসচিব আব্দুল খালেক যুগান্তরকে বলেন, ২০০৮ সালের পর থেকে এ অবৈধ সরকারের আমলে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী অন্যায়ভাবে পদোন্নতিবঞ্চিত ও নানাভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন এবং চাকরিচ্যুত করা হয়েছে; তাদেরকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়াসহ প্রাপ্য আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এজন্য গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে দ্রুত একটি কমিশন গঠন করতে হবে। একই সঙ্গে তিনি দাবি করেন, যারা এসব অন্যায় কাজের অন্যতম সহযোগী, সেসব কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি বলেন, আমরা শুধু পদোন্নতিবঞ্চিত হইনি, সমাজে নানাভাবে হেয়প্রতিপন্ন হয়েছি।
সূত্রমতে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ১৯৭৯, ১৯৮১, ৮২ নিয়মিত, ৮২ বিশেষ, ৮৪, ৮৫, ৮৬, ৯ম, ১০ম, ১১তম, ১৩তম, ১৫তম, ১৭, ১৮, ২০, ২১, ২২, ২৪, ২৫, ২৭, ২৮ ও ২৯ ব্যাচের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন ধাপে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তবে প্রতিটি পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা তাদের মেধা, যোগ্যতাসহ পদোন্নতির সব শর্ত পূরণ করা সত্ত্বেও পদোন্নতি পাননি। গোপনীয় নানা রিপোর্টের অজুহাতে তাদের পদোন্নতি থেকে বাইরে রাখা হয়েছে। কাউকে টানা ৪/৫ বার বঞ্চিত করা হয়েছে। কাউকে ১/২ বার বঞ্চিত করে পরের ধাপে পদোন্নতি দিলেও এরপর আর দেওয়া হয়নি।
সোমবার তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়, ভুক্তভোগীদের মধ্যে রয়েছেন ১৯৮২ ব্যাচের ড. আব্দুর রশীদ, আব্দুল বারী, সুরুতজ্জামান, আহমেদ উর রহিম, ১৯৮৪ ব্যাচের আব্দুল খালেক, ডা. আমিনুল ইসলাম, নেয়ামত উল্লাহ ভূঁইয়া, আব্দুল গণি, ওয়াসীম জব্বার, তালুকদার শামসুর রহমান, ফয়জুল কবীর, মিজানুর রহমান, ফিরোজ খান নুন, সদর উদ্দিন বিশ্বাস, ১৯৮৫ ব্যাচের কাজী মেরাজ হোসেন, কামরুজ্জামান চৌধুরী, সামসুজ্জোহা, মশিয়ুর রহমান, এবিএম সিরাজুল হক, আবুল কালাম আজাদ, হাবিবুর রহমান, আহসানুল জব্বার, ১৯৮৬ ব্যাচের জাকির হোসেন কামাল, মঞ্জুর মোর্শেদ, আব্দুল মতিন, আব্দুস ছালাম, শামীম আল মামুন, ১৫ ব্যাচের আফজালুর রহমান, ১৮ ব্যাচের জহিরুল ইসলাম, শাহ আলম, খন্দকার আজিম আহমেদ, আজিজুল ইসলাম, শহিদুল ইসলাম, হামিদুল হক, ফজলুর রহমান, মিজানুর রহমান, সুরাইয়া আখতার জাহান, সাখাওয়াত হোসেন, ড. এম সাইফুল আলম, সেলিম খান, আরফানুল হক, মাহফুজুর রহমান, জেসমিন নাহার, শরাফ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ও আবু সাইয়ীদ, ২৫ ব্যাচের নুরুল করিম ভূঁইয়া, মিনারা নাজমীন, ফরিদা খানম, সগীর হোসেন, হাসান হাবিব, জয়নুল আবেদীন, সজল নূর, মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ।
সূত্র: যুগান্তর।