বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৩৯ অপরাহ্ন

দ্বিমুখী চরিত্র: সমাজ ও ঈমানের নীরব বিষ

অনলাইন ডেস্ক রিপোর্ট
  • আপডেট টাইম: বুধবার, ৫ নভেম্বর, ২০২৫
মানুষের চরিত্র ও নৈতিকতা ইসলামের শিক্ষা ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেছেন—

إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ

“নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন।” (সুরা মায়িদাহ আয়াত :৪২)

অন্যদিকে, ভণ্ডামি, দ্বিমুখী আচরণ ও প্রতারণা ইসলামের নৈতিকতার পরিপন্থী। মুনাফিকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো—সে ভেতরে এক রকম, বাইরে অন্য রকম।

সমাজে অনেক সময় এমন মানুষ দেখা যায়, যারা এক দলের কাছে একরূপে, অন্য দলের কাছে ভিন্নরূপে আচরণ করে—কখনও চাটুকার, কখনও ধোঁকাবাজ, কখনও উভয় পক্ষেরই সন্তুষ্টি লাভের আশায় দ্বিচারিতা করে। 

এই দ্বিমুখী চরিত্রই নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবচেয়ে নিকৃষ্ট গুণ বলে আখ্যায়িত করেছেন নিচের হাদীসে।

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ‏ “‏ إِنَّ شَرَّ النَّاسِ ذُو الْوَجْهَيْنِ الَّذِي يَأْتِي هَؤُلاَءِ بِوَجْهٍ وَهَؤُلاَءِ بِوَجْهٍ ‏”‏ ‏.‏

আবু হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। নিশ্চয়ই তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছেনঃ দু রূপধারী লোক সবচেয়ে নিকৃষ্ট, যে ব্যক্তি এ দলের নিকটে আসে একরূপ নিয়ে ও অন্যদলের কাছে আসে একরূপ নিয়ে।

(সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫২৬) 

হাদীসের প্রেক্ষাপট ও অর্থ

এই হাদিসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন এক নৈতিক ব্যাধির দিকে ইঙ্গিত করেছেন, যা সমাজে ফিতনা, অবিশ্বাস ও শত্রুতা সৃষ্টি করে।

“ذَا الْوَجْهَيْنِ (দু-মুখো ব্যক্তি)” বলতে এমন মানুষ বোঝানো হয়েছে, যে দুই দলের মধ্যে নিজেকে উভয়ের বন্ধু হিসেবে দেখাতে চায়, কিন্তু বাস্তবে কাউকেই সত্যিকারভাবে ভালোবাসে না। একদলকে অন্যদলের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে নিজে লাভবান হয়।

ইমাম নববী (রহ.) বলেন—

“المراد به الذي يظهر لكل طائفة أنه منهم ويوافقهم على ما يقولون.”

অর্থাৎ, “এমন ব্যক্তি, যে প্রতিটি দলের কাছে নিজেকে তাদের দলের সদস্য হিসেবে প্রকাশ করে এবং তাদের মতবাদে সম্মতি দেয়।

” (শরহ সহীহ মুসলিম, নববী, ১৬/১৬৪) 

যে কারণে নবীজি (সা.) এমন লোককে“নিকৃষ্টতম” বলেছেন

ইবনে হাজর (রহ.) ব্যাখ্যা করেছেন— “কারণ এই ব্যক্তির ভিতরে রয়েছে মুনাফিকের চরিত্র, যে এক অবস্থায় ঈমান প্রকাশ করে আর অন্য অবস্থায় কুফর বা শত্রুতা লুকায়।” (ফাতহুল বারী, ১০/৪৭১)

দ্বিমুখী মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি করা পারস্পরিক বিশ্বাসের পরিবেশ নষ্ট করে। সে সমাজে অশান্তি, বিভাজন ও অবিশ্বাসের আগুন ছড়িয়ে দেয়। তাই নবীজি (সা.) একে ‘নিকৃষ্টতম’ বলে অভিহিত করেছেন।

কোরআনের দৃষ্টিতে দ্বিমুখিতা

কোরআনে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যেও এই গুণটি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে—

“وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ آمَنُوا قَالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلَى شَيَاطِينِهِمْ قَالُوا إِنَّا مَعَكُمْ”

“যখন তারা মুমিনদের সাথে সাক্ষাৎ করে বলে, আমরা বিশ্বাসী; আর যখন নিজেদের শয়তানদের সাথে একান্ত হয়, বলে—আমরা তো তোমাদেরই সাথী।

” (সুরা বাকারা আয়াত :১৪) 

অতএব, এই দ্বিমুখী আচরণ মুনাফিকিরই একটি রূপ, যা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

নৈতিক শিক্ষা

ইমাম গাজালী (রহ.) তাঁর “ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন”-এ বলেন— “দ্বিমুখী মানুষ আল্লাহর নিকট ঘৃণিত, কারণ সে কারো সাথেই আন্তরিক নয়। সে প্রতারণায় পারদর্শী, ঈমানের গুণাবলি তার মধ্যে নেই।”

এই হাদিস আমাদের শিক্ষা দেয় যে, একজন মুমিনের চরিত্র হওয়া উচিত স্বচ্ছ ও একরূপ—যেমন তিনি প্রকাশ্যে, তেমনি অন্তরেও। আন্তরিকতা ও সততা হলো মুমিনের পরিচয়।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে এমন এক নৈতিক বিপদ থেকে সতর্ক করেছেন, যা সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি করে ও ঈমানকে কলুষিত করে। একরূপ চরিত্র, সত্যবাদিতা ও আমানতের প্রতি বিশ্বস্ততাই মুমিনের সৌন্দর্য। দ্বিমুখিতা সেই সৌন্দর্যের বিনাশ ঘটায়।

কাজেই দ্বিমুখী বা ভণ্ডামিপূর্ণ আচরণ ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্যতম গুণ। এটি মুনাফিকির উপসর্গ, যা ঈমান ধ্বংস করে।

নিউজটি শেয়ার করুন..

  • Print
  • উত্তরা নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন:
এ জাতীয় আরো খবর..
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৩-২০২৫ | Technical Support: Uttara News Team
themesba-lates1749691102