আত্মীয়তার মূল পরিধি
১. রক্ত-সম্পর্কীয় আত্মীয়: ইসলামে আত্মীয়তার প্রধান পরিধি হলো রক্ত-সম্পর্ক। কোরআন ও হাদিসে “রহিম” বা “উলুল আরহাম” শব্দের ব্যবহার মূলত মাতৃগর্ভ থেকে জেনারেল হওয়া রক্ত সম্পর্ককে নির্দেশ করে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত: পিতা-মাতা, দাদা-দাদি, নানা-নানি: যাদের ব্যাপারে কোরআনুল কারীমে বলা হয়েছে:
وَوَصَّيْنَا الإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ إِحْسَانًا
“আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে উত্তম ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছি।
রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়ের মধ্যে রয়েছে সন্তান-সন্ততি। যাদের ব্যাপারে হাদিসে বলা হয়েছে:
خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لأَهْلِهِ وَأَنَا خَيْرُكُمْ لأَهْلِي
‘তোমাদের মাঝে সে-ই ভাল যে তার পরিবার-পরিজনের নিকট ভাল। আর আমি আমার পরিবারের নিকট তোমাদের চাইতে উত্তম’। (তিরমিযি, হাদিস: ৩৮৯৫)
রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়ের মধ্যে আরও রয়েছে আপন ভাই-বোন।রয়েছেন চাচা-চাচি, খালা-খালু, মামা-মামী, ফুফু-ফুফা ও তাদের সন্তানরা। ইসলাম চাচাকে পিতার সমতুল্য বলে সম্মান দেখাতে বলেছে। এই রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা ইসলামে হারাম। কোরআন স্পষ্টভাবে সতর্ক করে:
فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ
“তোমরা কি এমন নও যে, যদি মুখ ফিরিয়ে নাও তবে জমিনে অনর্থ সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে? এরাই তারা যাদের প্রতি আল্লাহ অভিশাপ দিয়েছেন।” (সূরা মুহাম্মদ: ২২-২৩)
২. রক্ত সম্পর্ক ছাড়াও আত্মীয়তার আওতা: শরীয়তের ভাষায় “সিলাতুল রাহিম” বা আবশ্যকভাবে সম্পর্ক রক্ষা মূলত রক্ত আত্মীয়দের সঙ্গেই প্রযোজ্য।
ক. শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়
কোরআনে স্ত্রী-আত্মীয়দেরকেও পরোক্ষভাবে আত্মীয় বলা হয়েছে:
وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْمَاءِ بَشَرًا فَجَعَلَهُ نَسَبًا وَصِهْرًا
‘আল্লাহ পানির দ্বারা মানুষ সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তাকে আবদ্ধ করেছেন রক্তের বন্ধনে ও বৈবাহিক বন্ধনে।” (সূরা ফুরকান, আয়াত: ৫৪)।
খ. দুধ সম্পর্কীয় আত্মীয় (রিদা’আ)
দুধ সম্পর্কীয় আত্মিয়দের সাথেও শশুর বাড়ির আত্মিয়দের মতো উত্তম আচরণ করার ব্যাপারে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছে:
وَأُمَّهَاتُكُمُ اللاَّتِي أَرْضَعْنَكُمْ وَأَخَوَاتُكُم مِّنَ الرَّضَاعَةِ
‘তোমাদের দুধ-মা এবং দুধ-ভাইবোনও (তোমাদের মাহরাম)।” (সূরা নিসা, আয়াত: ২৩) এখানে দুভ ভাইবোনদের আপন ভাই‘ বোনের মতো মাহরাম ঘোষনা দিয়ে এ কথা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, তারাও আপন ভাই বোনের মতো মজবুত বন্ধনে আবদ্ধ থাকা আবশ্যক। সুতরাং এই আত্মীয়দের সাথেও সদাচরণ ইসলামের দায়িত্ব।
৩. সামাজিক সদ্ব্যবহারের আওতা
রক্ত আত্মীয় নন এমন ব্যক্তিদের সাথেও সদাচরণ করা ওয়াজিব নয় তবে এ ক্ষেত্রেও সদাচরণ ইসলামে উৎসাহিত করা হয়েছে।
ক. প্রতিবেশী
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে:
وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا … وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ
“আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না; পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো … নিকটবর্তী প্রতিবেশী ও দূরবর্তী প্রতিবেশীর সাথে।” (সুরা নিসা, আয়াত : ৩৬)
মহানবী (সা.) বলেছেন: “জিবরাইল আমাকে প্রতিবেশীর হক সম্পর্কে এত বার নসিহত করেছেন যে আমি ভেবেছিলাম তিনি তাকে উত্তরাধিকারী বানাবেন।” (বুখারি, হাদিস: ৬০১৪; মুসলিম, হাদিস: ২৬২৫)
খ. মুসলিম ভাই ও সাধারণ মানুষ
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে:
وَأَحْسِنُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ
‘সৎকর্ম করো, নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন।” (সূরা বাকারা: ১৯৫)
মহানবী (সা.) বলেছেন: “মুমিনরা একে অপরের জন্য যেন একটি দেহের মতো; যদি শরীরের এক অঙ্গ কষ্ট পায়, পুরো শরীর জাগ্রত ও ব্যথিত হয়” (মুসলিম, হাদিস: ২৫৬৪)
৪. আত্মীয় খারাপ ব্যবহার করলে করণীয়
যদি কোনো আত্মীয় খারাপ ব্যবহার করেও থাকে, ইসলাম তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার অনুমতি দেয় না।
রাসূল (সা.) বলেছেন:
لَيْسَ الْوَاصِلُ بِالْمُكَافِئِ، وَلَكِنِ الْوَاصِلُ الَّذِي إِذَا قَطَعَتْ رَحِمُهُ وَصَلَهَا
“প্রতিদানকারী আত্মীয়তার হক সংরক্ষণকারী নয়। বরং আত্মীয়তার হক সংরক্ষণকারী সে ব্যক্তি, যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হবার পরও তা বজায় রাখে।” (বুখারি, হাদিস: ৫৯৯১)
কোরআনেও নির্দেশ এসেছে:
ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ
“তুমি মন্দকে উত্তম দ্বারা প্রতিহত করো। তখন দেখবে, যার সাথে তোমার শত্রুতা ছিল সে যেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেছে।” (সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ৩৪)
তবে রক্ত সম্পর্কীয় ছাড়া অন্য শ্রেণি আত্মিয় যদি এমন কোনো অনাচার বা জুলুম করেন যার দ্বারা ব্যক্তির বড় ধরনের ক্ষতি হয়। তার পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় নিপতিত হয়। সে ক্ষেত্রে এ ধরনের আত্মিয় থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলার অবকাশ রয়েছে।