১. আল-জাজারির হাতির ঘড়ি
আল-জাজারির আরেকটি অনন্য সৃষ্টি হলো হাতির ঘড়ি। এটি ছিল এক বিশাল স্বয়ংক্রিয় ঘড়ি, যেখানে গ্রিক জল-উত্তোলন প্রযুক্তি, ভারতীয় হাতি, মিসরীয় ফিনিক্স, আরবীয় মূর্তি ও চীনা ড্রাগনের সমন্বয় ঘটানো হয়েছিল। এই ঘড়ি শুধু সময় নির্দেশ করত না, বরং বিশ্বের নানা সংস্কৃতির ঐক্য ও বৈচিত্র্যকেও উদযাপন করত। প্রতি ঘণ্টায় বিভিন্ন যান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া ঘটত, যা দর্শকদের বিস্মিত করত।
৩. উমাইয়া মসজিদের ঘড়ি
১৩ শতকে দামেস্কের বিখ্যাত উমাইয়া মসজিদে নির্মিত এই ঘড়ি রিদওয়ান আল-সাআতি পুনর্নির্মাণ করেন। এটি ছিল অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক যান্ত্রিক ঘড়ি, যেখানে সময় সংখ্যাগতভাবে প্রদর্শিত হতো।ঘড়িতে দুটি বাজপাখি ছিল, যারা প্রতি ঘণ্টায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে তামার বল ফেলে ঘণ্টা পরিবর্তনের সংকেত দিত। রাতে একটি বাতি ঘূর্ণন চাকতির মধ্য দিয়ে আলোকিত হয়ে ঘণ্টা নির্দেশ করত।এই ঘড়ির ইঞ্জিন ছিল জলচালিত, দড়ি ও পুলির মাধ্যমে ওপরের অংশে শক্তি সরবরাহ করত। জল প্রবাহের গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ ভালভ ব্যবহৃত হতো।
৪. আল-মুরাদির ‘বুক অব সিক্রেটস’ ও জলঘড়ি
একাদশ শতাব্দীর আল-মুরাদি তাঁর ‘বুক অব সিক্রেটস’ গ্রন্থে জলঘড়ি ও অটোমেটা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেন।এই বইয়ে ৩১টি মডেল বর্ণিত হয়েছে, যার মধ্যে ১৯টি ছিল এমন ঘড়ি, যা অটোমেটার গতিবিধির মাধ্যমে ঘণ্টা রেকর্ড করত।এই ঘড়িগুলোতে প্রবাহিত জল ও পারদের জটিল ব্যবহারের মাধ্যমে গিয়ারিং সিস্টেম তৈরি করা হয়েছিল, যা উচ্চ টর্ক প্রেরণে সক্ষম ছিল। ইউরোপে পরবর্তীকালে যে পারদচালিত ঘড়ি দেখা যায়, তার উৎস এই মুসলিম উদ্ভাবনেই নিহিত।
৫. আল-কারাউইন মসজিদের ঘড়ি
মরক্কোর ফেজ শহরের কারাউইন মসজিদের মিনারে ১২৮৬/৮৭ সালে ইবনে আল-হাব্বাক আল-তিলিমসানি একটি জলঘড়ি নির্মাণ করেন। ১৩৪৬-৪৮ সালে আবু আবদুল্লাহ আল-আরাবি এটিকে পুনরুদ্ধার করেন এবং তারাগুলোর গতি পর্যবেক্ষণের জন্য জ্যোতির্বিদ্যা রেট সংযোজন করেন। ঘড়িটি ছিল ২.৪ মিটার উঁচু এবং ১.২ মিটার বর্গক্ষেত্রের একটি কেবিনেটে স্থাপিত। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় রেটটি একবার ঘুরত, যা ফেজের দিগন্তের চারপাশে আকাশের আপাত দৈনিক ঘূর্ণন অনুকরণ করত। প্রতি ঘণ্টায় ধাতব বল পড়ে সময় নির্দেশ করত।
৬. ইবনে হাইসামের যান্ত্রিক জলঘড়ি
অপটিকসের জনক হিসেবে খ্যাত ইবনে আল-হাইসাম (৯৬৫-১০৪০) তাঁর ‘মাকালা ফি আমাল আল-বিনকাম’ গ্রন্থে জলঘড়ির বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি প্রথমবারের মতো এমন জলঘড়ি তৈরি করেন, যা ঘণ্টা ও মিনিট উভয়ই নির্দেশ করতে পারত। তাঁর উদ্ভাবিত ঘড়িতে সিলিন্ডারের গোড়ায় ছোট ছিদ্র দিয়ে প্রবাহিত জল সময় নির্ধারণ করত। তিনি প্রবাহিত ক্লিপসিড্রা ব্যবহার করেন, যা পূর্ববর্তী বহির্গমন ক্লিপসিড্রার চেয়ে উন্নত ছিল। কায়রোতে অবস্থানকালে তিনি এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেন, যা পরবর্তী সময়ে মুসলিম প্রকৌশলীদের দ্বারা আরো উন্নত করা হয়।
৭. তাকিউদ্দিনের যান্ত্রিক ঘড়ি
ষোড়শ শতাব্দীর উসমানীয় প্রকৌশলী তাকিউদ্দিন (১৫২৬-১৫৮৫) যান্ত্রিক জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ঘড়ি নির্মাণে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর বই ‘আল-কাওয়াকিব আল-দুররিয়া ফি ওয়াধ আল-বানকামাত আল-দাওরিয়া’তে তিনি ঘণ্টা, ডিগ্রি ও মিনিট দেখানোর জন্য তিনটি ডায়ালবিশিষ্ট ঘড়ির বর্ণনা দেন। তাঁর উদ্ভাবিত ঘড়িতে অ্যালার্ম, ঘণ্টা বাজানোর ব্যবস্থা, সূর্য-চাঁদের অবস্থান, চাঁদের বিভিন্ন পর্যায়, নামাজের সময় নির্দেশক এবং গ্রেগরিয়ান মাসের প্রথম দিন দেখানোর ডায়াল ছিল। তাঁর যান্ত্রিক ঘড়ি মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের ঘড়ি নির্মাণে গভীর প্রভাব ফেলে এবং আধুনিক ঘড়ির প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপন করে।
মুসলিম সভ্যতার ঘড়ি নির্মাণের বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমন্বয় : মুসলিম উদ্ভাবকরা কেবল সময় পরিমাপের যন্ত্রই তৈরি করেননি, বরং জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও প্রকৌশলের সমন্বয়ে অত্যন্ত জটিল ও কার্যকর যন্ত্র নির্মাণ করেছিলেন।
স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ : এই ঘড়িগুলোতে স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ছিল, যেমন ঘণ্টা পরিবর্তনের সময় অটোমেটিক দরজা খোলা, মূর্তি নড়াচড়া, বল পড়া ইত্যাদি।
সৃজনশীলতা ও বৈচিত্র্য : ঘড়িগুলোতে বিভিন্ন দেশের প্রতীকী উপাদান, শিল্পকলা ও কারুশিল্পের অপূর্ব সমন্বয় দেখা যায়। যেমন—হাতির ঘড়িতে ভারত, চীন, মিসর ও আরবের প্রতীক একত্রিত করা হয়েছে।