মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫, ০৯:০১ অপরাহ্ন

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ঈদুল আজহার প্রভাব

অনলাইন ডেক্স রির্পোট
  • আপডেট টাইম: মঙ্গলবার, ১৭ জুন, ২০২৫
বাংলাদেশ মুসলিমপ্রধান দেশ। বছরে মুসলমানদের প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। দুই ঈদকে ঘিরে পোশাক তৈরি ও বিক্রি, পোশাক আমদানি, মসলাপাতি আমদানি ও বিক্রি, চাকরিজীবীদের বোনাসপ্রাপ্তি, কোরবানির গরু-ছাগল, মহিষ, ভেড়া ইত্যাদির ব্যাপক চাহিদা এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেশে রেমিট্যান্স পাঠানো স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। দেশের অর্থনীতিতে সঞ্চারিত হয় গতিশীলতা, কর্মতৎপরতা ও প্রাণচাঞ্চল্য।ঈদ উৎসব ও দেশের অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

কোরবানির পশুর বাজার এবং এর সঙ্গে ব্যবসায় জড়িত কর্মকাণ্ড : ঈদুল আজহা উপলক্ষে পশু লালন-পালন ও কোরবানির পশু বিক্রি দেশের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করে। এবারের অর্থাৎ ২০২৫ সালের ঈদুল আজহায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, পশু কোরবানি হয়েছে ৯১ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৪টি। এর মধ্যে গরু-মহিষের সংখ্যা ছিল ৪৭ লাখ পাঁচ হাজার ১০৬টি।

ছাগল ও ভেড়া ছিল ৪৪ লাখ ৩০ হাজার ৬৬৮টি এবং উট, দুম্বাসহ অন্যান্য প্রাণী ছিল ৯৬০টি। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী ঈদুল আজহায় সারা দেশে মোট  এক কোটি চার লাখ আট হাজার ৯১৮টি পশু কোরবানি করা হয়েছিল, যা এ বছরের তুলনায় ছিল ১২ লাখ ৭২ হাজার ১৮৪টি বেশি।কোরবানির ঈদ উদযাপন উপলক্ষে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয় পশুর বাজারে। এক হিসাব মতে, ২০২৪ সালে ঈদুল আজহায় সারা দেশে কোরবানির পশুর বাজারে সার্বিক আর্থিক লেনদেন হয়েছিল ৬৯ হাজার কোটি টাকার।
কোরবানিকৃত পশুর সরবরাহ ও বেচাকেনার পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চাঁদা, টোল, বকশিশ, চোরাকারবার, ফড়িয়া, দালাল, হাসিল, পশুর হাট ইজারা, রশি, বাঁশ ও খুঁটির ব্যবসা, পশুর খাবার ও পশু কোরবানি ও গোশত বানানো, এমনকি পশুর সাজগোজের জন্য বিপুল আর্থিক লেনদেন হয়। ফলে অর্থনীতিতে আর্থিক লেনদেন ও মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়। তা ছাড়া কোরবানি করা পশুর চামড়া বেচাকেনা, সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য প্রচুর আর্থিক লেনদেন হয়। পশুর চামড়া রপ্তানি বাণিজ্য, পাদুকাশিল্প এবং হস্তশিল্পেও ব্যাপক আর্থিক লেনদেন হয়ে থাকে।এক তথ্য মতে, দেশে বিভিন্ন পর্যায়ে ১৭ লাখ ছোট-বড় খামার আছে।
এর সঙ্গে প্রায় কোটি মানুষ জড়িত। এরা গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা পালন করে। এ সময় চামড়াশিল্পে ব্যাংক বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। কোরবানির ঈদে পশুর চামড়া সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ও ব্যবসা জড়িত। এ সময় চামড়াশিল্পে সরকারি ব্যাংকগুলো প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে থাকে। এতে ব্যাংকের আয় যেমন বাড়ে, তেমনি চামড়াশিল্পের আয়-উন্নতিও বৃদ্ধি পায়। তা ছাড়া এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। লবণ চামড়াশিল্পে চামড়া সংরক্ষণের একটি অন্যতম উপাদান। এ জন্য দেশি শিল্পে লবণ উৎপাদন এবং চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে প্রয়োজনে আমদানিও বেড়ে যায়। এর ফলে ব্যবসায়ী, লবণশিল্প এবং পাদুকাশিল্পের আর্থিক তৎপরতা ও কর্মকাণ্ড অনেক বেড়েছে। ঈদ উপলক্ষে প্রতিবছর ফ্রিজের বিক্রি বেড়ে যায়। কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে তিন-চার হাজার কোটি টাকার ফ্রিজ বিক্রি হয় বলে জানা যায়। ফলে এই শিল্পের উৎপাদন ও তৎপরতা অনেক বেড়ে যায়, যা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। 

অর্থনীতিবিদ মাহফুজ কবীর বলেন, ২০২৫ সালের ঈদের বাজারে সার্বিক লেনদেন এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

কোরবানির মাংস প্রাণিজ আমিষের উৎস : ঈদুল আজহা উপলক্ষে সারা দেশে পশু কোরবানির ফলে কোরবানিদাতা, তাদের আত্মীয়-স্বজন এবং সমাজের ব্যাপক গরিব, দুঃখী ও অভাবী মানুষের মধ্যে আমিষের সরবরাহ বেড়ে যায়। অনেক কোরবানিদাতা সারা বছর এই মাংস সংরক্ষণ করে আমিষের চাহিদা পূরণ করেন।

মসলা, পেঁয়াজ, রসুন ও অন্যান্য পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হয় : কোরবানির সময় ধনী-দরিদ্র-নির্বিশেষে সবার ঘরে ঘরে কোরবানির মাংস রান্নার হিড়িক পড়ে যায়। সেদিন দুপুরবেলায় মানুষ পরম আনন্দে সতেজ মাংস রান্না করে তৃপ্তি সহকারে খেতে বসে। আমাদের দেশে খাবার সুস্বাদু করার জন্য মাংস রান্নার কাজে মানুষ হরেক রকম মসলা ব্যবহার করে। গরম মসলা, বিশেষ করে এলাচ, দারচিনি, লবঙ্গ, জিরা, তেজপাতা কোরবানির সময় উল্লেখযোগ্য হারে ব্যবহৃত হয়। এসব পণ্য অনেক আমদানি করতে হয়। কোরবানির বাজারে এসব পণ্যে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। এই হিসাবের বাইরেও ঈদের আগে চোরাপথে মায়ানমার ও ভারত থেকে প্রচুর মসলা আসে। এর ফলেও অর্থের লেনলেন অনেক বেড়ে যায়। রান্নার কাজে ব্যবহৃত বড় একটি উপাদান পেঁয়াজ। প্রতিবছর দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২২ লাখ টন। রসুন ও আদার চাহিদা যথাক্রমে পাঁচ লাখ ও তিন লাখ টন।

কোরবানির সময় এসব পণ্যের ব্যবহার অনেক বেড়ে যায়। ফলে চাহিদাও বেড়ে যায়। কোরবানির সময় ছুরি, বঁটি, দা, চাপাতি, কুড়াল, রামদা, কাঠের গুঁড়ি, চাটাই, পলিব্যাগ ইত্যাদি ছাড়া কোরবানির পশু জবাই, কাটাকাটি সম্ভবই হয় না। এর পেছনে খরচের কোনো সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, কোরবানিতে পণ্যগুলোর বাজার প্রায় এক হাজার কোটি টাকারও বেশি।

পরিবহন খাতে গতি আনে ঈদ : আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ঈদের সময় ঈদ উপলক্ষে বোনাস দেওয়া হয়। এক হিসাব মতে, দেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে বোনাস বিতরণ করা হয় প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। দেশব্যাপী ৬০ লাখ দোকান কর্মচারীদের বোনাস আসে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। পোশাক ও বস্ত্র খাতের ৭০ লাখ শ্রমিকের সম্ভাব্য বোনাস তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তা ছাড়া আছে বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বোনাস। সব মিলিয়ে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ঈদ উপলক্ষে অর্থনীতিতে বাড়তি যোগ হয়। ফলে অর্থনীতিতে মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে যায়। এই অর্থ কিন্তু বসে থাকে না, বরং তা বাজারে চাহিদা সৃষ্টি করে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের গতিকে প্রভাবিত করে। তখন মানুষ জামা-কাপড়, জুতা, প্রসাধনী, আতর, জায়নামাজ ইত্যাদিসহ নানা খাতে যেমন অর্থ ব্যয় করে, তেমনি গরিব-দুঃখী ও অভাবী মানুষকে দান করার ফলে অর্থনীতিতে অসাধারণ প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হয়। এ সময় দেশে বেশির ভাগ শহুরে মানুষ মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করার জন্য গ্রামের বাড়িতে ছুটে যায়। ফলে ট্রেন ও বাস মালিক সবার ব্যবসায় গতি আসে। এতে কোরবানির সময় পরিবহন খাতে যে বাড়তি চাপ তৈরি হয়, তাতে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার বাড়তি ব্যবসা ও লেনদেন হয়ে থাকে। এই কর্মকাণ্ডের ফলে অর্থনীতির চাকা গতি লাভ করে।

বৈদেশিক মুদ্রাপ্রবাহ অর্থনীতির ভিতকে মজবুত করে : কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে প্রবাসী রেমিট্যান্সের প্রবাহ অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। প্রবাসীরা তাঁদের পরিবার-পরিজনের নানা ধরনের ঈদ খরচ ও কোরবানির জন্য প্রচুর বিদেশি মুদ্রা পাঠিয়ে থাকেন। এতে অর্থনীতিতে লেনদেন বেড়ে যায় এবং জাতীয় অর্থনীতির ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৪ সালে দেশে রেমিট্যান্সপ্রবাহ নতুন রেকর্ড করেছে। পুরো বছরে মোট রেমিট্যন্স আসে ২৬.৯ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ২৩ শতাংশ বেশি। আগস্ট বিপ্লবের পর থেকে প্রতি মাসে দেশে গড়ে রেমিট্যান্সপ্রবাহ রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে যায়। ২০২৫ সালে জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত (মানে ঈদের ঠিক আগের মাস) দেশে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে তা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে রেমিট্যান্স দেশে প্রবেশ করে যথাক্রমে ২.১৮ বিলিয়ন, ২.৫৮ বিলিয়ন, ২.৬৩ বিলিয়ন, ২.৭৫ বিলিয়ন ও ২.৯৭ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল যথাক্রমে ৩.২৯ বিলিয়ন, ২.৫২ বিলিয়ন, ২.১৮ বিলিয়ন, ২.০৪ বিলিয়ন ও ২.২৫ বিলিয়ন ডলার। এবারের ঈদের আগের মাস তথা মে মাসে রেমিট্যান্সের এই প্রবাহ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বিশাল অঙ্কের রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতির চাকাকে যেমন সচল করেছে, তেমনি পতিত সরকারের তলানিতে যাওয়া রিজার্ভকেও শক্তিশালী করছে।

পরিশেষে, ঈদুল আজহা আমাদের জাতীয় জীবনে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনীতির সমৃদ্ধি ও অগ্রগতিতে বিশাল অবদান রেখে চলেছে।

নিউজটি শেয়ার করুন..

  • Print
  • উত্তরা নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন:
এ জাতীয় আরো খবর..
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৩-২০২৫ | Technical Support: Uttara News Team
themesba-lates1749691102