ইসলামে জাতীয় ঐক্যের গুরুত্ব
অনলাইন ডেক্স রির্পোট
-
আপডেট টাইম:
বৃহস্পতিবার, ২৯ মে, ২০২৫
জাতীয় ঐক্য কোনো বিলাসিতা নয়, এটি জাতির অস্তিত্ব রক্ষার পূর্বশর্ত। একটি জাতি যদি বিভক্ত হয়ে পড়ে, তবে তার শক্তি নিঃশেষ হতে শুরু করে। আত্মপরিচয় বিলুপ্ত হয় এবং একসময় রাষ্ট্রব্যবস্থাও ধসে পড়ে। সুতরাং জাতীয় ঐক্য আলোকোজ্জ্বল এক শক্তির নাম, যা বিচ্ছিন্ন হূদয়গুলোকে এক সুতায় গেঁথে দেয়, জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় অবিচল ছায়া হয়ে দাঁড়ায়।ইসলামের মৌলিক দর্শনে জাতীয় ঐক্য শুধু রাজনৈতিক প্রয়োজনে নয়, বরং তা ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক দায়িত্ব হিসেবেও বিবেচিত। কারণ ইসলাম শুধু ব্যক্তির নৈতিকতা কিংবা ইবাদতের পথ প্রদর্শক নয়, বরং সৌহার্দ্যপূর্ণ সামজিক কাঠামো গড়ারও বিস্তৃত দিকনির্দেশনা। এই নির্দেশনার অন্যতম স্তম্ভ হলো জাতীয় ঐক্য।পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং পরস্পরে বিভক্ত হয়ো না।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৩)এই আয়াতে ‘আল্লাহর রজ্জু’ বলতে বোঝানো হয়েছে কোরআন, সুন্নাহ ও আল্লাহর বিধান। এটি শুধু ধর্মীয় নির্দেশনা নয়, বরং একটি জাতিকে কিভাবে সংহত ও সুসংবদ্ধ রাখা যায় তার মৌলিক ভিত্তি। ঐক্যহীনতা মানেই অস্থিরতা, দুর্বলতা এবং ধ্বংসের দিকে যাত্রা।ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করেন, তখন তিনি প্রথমেই মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করেন।তারপর ‘মদিনা সনদ’ প্রণয়ন করে বহুজাতিক সমাজে শান্তি ও সংহতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। যা ছিল ইতিহাসের প্রথম লিখিত সংবিধান; যেখানে মুসলিম, ইহুদি ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও নিরাপত্তা রক্ষার অঙ্গীকার ছিল।ঐক্য ভঙ্গের পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, কোরআনুল কারিমে সে ব্যাপারে সতর্কবার্তা উচ্চারণ করে বলা হয়েছে—‘তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা সুস্পষ্ট নিদর্শন আসার পরেও বিভক্ত ও মতভেদে লিপ্ত হয়েছিল।’(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৫)ইসলাম গোত্রগত অহংকার, সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামি এবং দলগত বৈষম্যের ঘোরতর বিরোধী। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জাতিগত গর্বে আহবান জানায়, সে-ই উগ্রতায় লড়াই করে বা তাতে নিহত হয়, সে জাহিলি যুগের মৃত্যুবরণ করল।(মুসলিম, হাদিস : ১৮৫০)।এই হাদিস শুধু তৎকালীন আরব গোত্রীয় বিভাজনের নিন্দা নয়, বরং সব যুগের বিভাজনকারী রাজনীতি ও উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রতি এক চিরন্তন প্রতিবাদ।আধুনিক বিশ্বে মুসলিম উম্মাহর বিপর্যয়ের পেছনে অন্যতম কারণ এই ঐক্যহীনতা। রাজনৈতিক মতভেদ, মতবিরোধপূর্ণ দলাদলি ও কৌশলগত বিভাজনই মুসলিম জাতিকে শক্তিহীন ও পরনির্ভর করে দিচ্ছে। অথচ রাসুল (সা.) বলেন, ‘এক মুসলিম আরেক মুসলিমের জন্য একটি দালানের মতো, যার এক অংশ অন্য অংশকে শক্ত করে ধরে।’ (বুখারি, হাদিস : ৪৮১)ঐক্যের সৌন্দর্য ও শক্তি ফুটে ওঠে মুসলমানদের প্রথম যুগের ইতিহাসে। খিলাফতে রাশেদা, উমাইয়া, আব্বাসিয়া ও উসমানিয়া খিলাফতের বিস্তৃতি, জ্ঞান, সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশ এ কথাই প্রমাণ করে যে ঐক্য থাকলে বিজয় আসে, উন্নয়ন ঘটে, সভ্যতা গড়ে ওঠে।আজ বাংলাদেশসহ বিশ্ব মুসলিম সমাজে রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক বিভাজনের যে ভয়াবহ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে—তা শুধু আত্মঘাতী নয়, বরং ইসলামী মূল্যবোধের বিরুদ্ধেও এক মারাত্মক অমান্যতা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মুমিনদের পারস্পরিক ভালোবাসা, দয়া ও সহানুভূতির দৃষ্টান্ত একটি দেহের মতো; দেহের একটি অঙ্গ ব্যথিত হলে সারা দেহ জেগে ওঠে জ্বরে ও কষ্টে।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৫৮৬)এমন শিক্ষা একমাত্র ইসলামই দিতে পারে, যা জাতিকে জাতিতে, হূদয়কে হূদয়ে এবং রাষ্ট্রকে সমাজে রূপান্তর করে দেয়।সুতরাং জাতীয় ঐক্য রক্ষা করা শুধু কৌশলগত সিদ্ধান্ত নয়, এটি ঈমানের দাবি, এটি ইসলামী সভ্যতার আত্মা। এই ঐক্য ছাড়া যেমন উন্নয়ন অসম্ভব, তেমনি রক্ষা করা যায় না স্বাধীনতা কিংবা সংস্কৃতি। ইসলাম আমাদের শেখায়—শক্তির উৎস অস্ত্র নয়, ঐক্য এবং শ্রেষ্ঠ অর্জন সম্পদ নয়, সংহতি।মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে দলীয় গোঁড়ামি, মতান্ধতা ও অন্ধ আদর্শিক অনুসরণ থেকে মুক্ত করে দেশ, জাতি ও মানবতার কল্যাণে ঐক্যের দীপ্তিময় মালা গেঁথে একটি শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের বাংলাদেশ গড়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
নিউজটি শেয়ার করুন..
-
-
-
- Print
- উত্তরা নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন:
এ জাতীয় আরো খবর..