সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫, ০৭:১৪ অপরাহ্ন

বাদশাহ আকবর যেভাবে হজ করতে গিয়েছিলেন

অনলাইন ডেক্স রির্পোট
  • আপডেট টাইম: রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫
৭ অক্টোবর ১৫৭৬। রাজদরবারে পিনপতন নীরবতা, ভক্তি, ভালোবাসা ও আধ্যাত্মিকতার আবহে পরিপূর্ণ। হীরা, জহরত ও দামি অলংকারে সজ্জিত রাজদরবার আজ যেন শিল্পীর আঁকা স্থিরচিত্র মাত্র। দরবারের সভাসদ ও মন্ত্রিবর্গ—যাঁরা ঝলমলে পোশাক পরিধান করে আছেন, যাঁদের কোমরে শোভা পাচ্ছে ঐশ্বর্যের তরবারি তাঁদের মুখমণ্ডলে গর্ব-গরিমার পরিবর্তে প্রস্ফুটিত হয়েছে পবিত্র আভা।রাজপ্রহরীরাও আজ অশ্রুসিক্ত আর হৃদয় আবেগে উদ্বেলিত। কেননা আজ তারা এমন দৃশ্য দেখছে, যা ভারতবর্ষের ইতিহাসে আগে কখনো দেখা যায়নি। সম্রাট আজ রাজকীয় পোশাক, অলংকার ও মুকুট পরিধান করে নয়, বরং তিনি ইহরামের দুই টুকরা সাদা কাপড় পরে দরবারে প্রবেশ করেছেন। আজ তাঁর পায়ে স্বর্ণের সুতায় সেলাই করা নকশাকার জুতাও নেই।তিনি খালি পায়ে, খালি মাথায় উপস্থিত ব্যক্তিদের উদ্দেশে কথা বলছেন। তাঁর মাথার চুলও এক পাশে মুণ্ডন করা। আজ তিনি কোনো প্রতাপশালী শাসক নন, আজ তিনি আল্লাহর পথের পথিক। তিনি আল্লাহর ঘরের মেহমান হতে এখনই যাত্রা শুরু করবেন এবং যাত্রার যাবতীয় প্রস্তুতিও সম্পন্ন হয়েছে।বাদশাহ হজ কাফেলার সঙ্গে যাত্রা শুরু করেন। তাঁদের সঙ্গে শহর ছেড়ে কিছুদূর অগ্রসরও হন। কিন্তু তখনই সৈন্যদের মিথ্যা মাতমে বাদশাহ বিভ্রান্ত হন। বাদশাহ তাদের মাতম উপেক্ষা করে কিছুদূর অগ্রসর হলেন বটে, কিন্তু তাঁর হজে যাওয়া হলো না। সম্রাট হজ কাফেলাকে বিদায় দিলেন এবং বায়তুল্লাহ জিয়ারতের আক্ষেপ বুকে নিয়ে প্রাসাদে ফিরে এলেন।মোল্লা আবদুল কাদের বাদায়ুনি তাঁর ‘মুনতাবুত তাওয়ারিখ’ বইয়ে এভাবেই সম্রাট আকবরের অসমাপ্ত হজযাত্রার চিত্র তুলে ধরেছেন। ১৫৭৬ সালে যখন সম্রাট আকবরের অন্তরে বায়তুল্লাহ জিয়ারতের আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়ে উঠেছিল, তখন সাম্রাজ্য তাঁর পায়ে শিকল হয়ে আটকে গিয়েছিল।আইনে আকবরের লেখক আবুল ফজল আল্লামি লেখেন, সেনাপতি, প্রশাসক ও রাজন্যবর্গের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত হজের ইচ্ছা থেকে সরে আসেন সম্রাট। ঐতিহাসিকদের ধারণা, রাজন্যবর্গ অনুরোধ না করলেও সম্রাটের জন্য হজের সফরে যাওয়া সহজ ছিল না। কেননা দীর্ঘ অনুপস্থিতি তাঁর রাজত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দিত। বিশেষত মধ্যযুগে ভারতবর্ষে ক্ষমতার পথ ছিল অত্যন্ত পিচ্ছিল। স্বয়ং সম্রাট আকবর তাঁর রাজত্বকালে ছোট-বড় প্রায় ৩০টি বিদ্রোহের মুখে পড়েন। তাঁর অবস্থা এমন ছিল যে তিনি বাংলার দিকে মনোযোগ দিলে কাবুল হাত থেকে ছুটে যেত। আর কাবুল ধরতে গেলে গুজরাটে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যেত।

সম্রাট আকবর হজে যেতে না পারলেও তিনি হজযাত্রীদের নানা ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। তিনি রাষ্ট্রীয় খরচে নাগরিকদের হজে পাঠানোর বিধান করেন। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর জনসাধারণকে রাষ্ট্রীয় খরচে হজ করার আহবান জানান। সে বছর সুলতান খাজা নকশাবন্দির নেতৃত্বে বিরাট হজ কাফেলা প্রেরণ করেন। এ ক্ষেত্রে সাধারণ হজযাত্রীদের পাশাপাশি কিছু মানুষকে জোরপূর্বক আরব ভূখণ্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। যেমন—সম্রাট হুমায়ুন তাঁর দুই বিদ্রোহী ভাই শাহজাদা কামরান ও শাহজাদা মুহাম্মদ আস্কারিকে মক্কায় নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন এবং সেখানেই তাঁরা মৃত্যুবরণ করেন।

সম্রাট আকবর প্রতিবছর রাষ্ট্রীয় খরচে হজ কাফেলা পাঠাতেন। তিনি তাঁর আমলে ‘আমিরুল হজ’ (হজ কাফেলার প্রধান) পদ সৃষ্টি করেন। তিনি হজ কাফেলার সঙ্গে মক্কা-মদিনার অধিবাসীদের জন্য বিপুল পরিমাণ উপঢৌকন পাঠাতেন। সম্রাট আকবর হাজিদের বিদায় দেওয়ার সময় তাদের সাদৃশ্য গ্রহণ করতেন। যেমন—তিনি ইহরাম পরতেন, মাথার চুল ছোট করতেন, তালবিয়া পাঠ করতেন এবং খালি মাথায়, খালি পায়ে হাঁটতেন।

১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে আমিরুল হজ শাহ আবু তুরাব (রহ.) হজ থেকে ফিরে আসার সময় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পদচিহ্নবিশিষ্ট একটি পাথর নিয়ে আসেন। রাসুল (সা.)-এর স্মৃতিচিহ্নের প্রতি সম্মান এবং হাজিদের অভ্যর্থনা জানাতে আগ্রা শহরের বাইরে তিনি চার ফারসাখ পর্যন্ত হেঁটে যান।

আবুল ফজল আল্লামি লেখেন, ১৫৭৯ সালে সম্রাট আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর ফুফু গুলবদন বেগম, স্ত্রী সেলিমা সুলতান বেগমসহ রাজপরিবারের একাধিক নারী হজে গমন করেন। খাজা ইয়াহইয়া এই কাফেলার আমিরুল হজ ছিলেন। তাঁরা ১৫ অক্টোবর ১৫৭৫ সালে আগ্রা থেকে যাত্রা শুরু করেন এবং ১৫৭৬ সালের অক্টোবর মাসে সুরত থেকে দুটি জাহাজে করে মক্কা ও মদিনার উদ্দেশে রওনা হন। এই কাফেলা ১৫৭৭ সালে জেদ্দায় পৌঁছে এবং সেখানে প্রায় চার বছর অবস্থান করে। এই সময়ে তাঁরা চারবার হজ পালন করেন।

১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে হজ শেষে তাঁরা ফিরে এলে তাঁদের উষ্ণ অভ্যর্থনা দেওয়া হয়। খাজা ইয়াহইয়ার মাধ্যমে মক্কার অভিজাত ব্যক্তিরা সম্রাটের কাছে সাহায্য চেয়ে একটি তালিকা পাঠিয়েছিলেন। এ ছাড়া সম্রাট মক্কা-মদিনার অসহায় ও দরিদ্র মানুষের তালিকা চেয়ে পাঠান এবং তাদের জন্য সাহায্য পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। পরের বছর সম্রাট তাদের দাবি অনুসারে উপহার ও সাহায্য পাঠান।

ঐতিহাসিক সূত্রগুলো বলে, প্রথম বছর সম্রাট আকবর তাদের জন্য ছয় লাখ রুপি এবং ১২ হাজার পোশাক পাঠান। পরের বছর পাঁচ লাখ রুপি ও ১০ হাজার পোশাক পাঠান। তৃতীয় বছর চার লাখ রুপি এবং ৯ হাজার পোশাক পাঠান। সম্রাটের সহযোগিতায় হিজাজে একটি মাদরাসা এবং কাদেরিয়া তরিকার খানকাও প্রতিষ্ঠিত হয়। মিথ্যা ধর্ম দ্বিনে এলাহির প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত সাহায্য পাঠানোর এই ধারা অব্যাহত ছিল। এরপর শুরু হয়েছিল সম্রাট আকবরের দুর্ভাগ্যের দিন।

পরবর্তী মোগল সম্রাটরা আরবে সাহায্য পাঠানোর এই ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন। তবে এর উদ্দেশ্য শুধু ধর্মভক্তি ছিল না। তাদের কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল। ইতিহাস গবেষকরা বলেন, মোগল সম্রাটরা বিপুল পরিমাণ উপহার পাঠাতেন কয়েকটি উদ্দেশ্যে : ১. মক্কা-মদিনার সঙ্গে ধর্মীয় সম্পর্ক ও পবিত্র ভূমির প্রতি সম্মান, ২. মুসলিম বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করা, ৩. মক্কা-মদিনার শাসকরা যেন ভারতীয় হাজিদের নিরাপত্তা ও অন্য সুযোগ-সুবিধার প্রতি সুদৃষ্টি দেন, ৪. আরব বিশ্বে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা।

নিউজটি শেয়ার করুন..

  • Print
  • উত্তরা নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন:
এ জাতীয় আরো খবর..
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৩-২০২৫ | Technical Support: Uttara News Team
themesba-lates1749691102