রবিবার, ১৮ মে ২০২৫, ১২:৪৩ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
নির্বাচনের দাবিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে ঘেরাও হবে জাতির জন্য দুভার্গ্য : সালাহউদ্দিন কুমিল্লায় বিএনপি অফিসে ‘পদবঞ্চিতদের’ আগুন, ককটেল বিস্ফোরণ গাজার ‘দখল ও নিয়ন্ত্রণ’ নিতে বড় ধরনের অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েল এনবিআরে কলম বিরতি চলবে কালও, রাজস্ব প্রশাসনে অচলাবস্থা বিয়ের ৮ দিনের মাথায় স্বামীকে হত্যা করলো নববধূ আগামী দু-এক মাসের মধ্যেই ইন্টারনেট গ্রাহকরা সুফল পাবে: উপদেষ্টা আসিফ ট্রাম্প শান্তির পক্ষে কথা বলেন আবার হুমকিও দেন: পেজেশকিয়ান উপদেষ্টা আসিফের পদত্যাগের দাবিতে ইশরাকের অনুসারীরা মাগুরায় শিশু আছিয়া ধ/র্ষ/ণ-হত্যা মামলায় প্রধান আসানি হিটু শেখের মৃত্যুদন্ড, খালাস-৩ ডিএমপির শ্রেষ্ঠ বিভাগ উত্তরা, থানা উত্তরা পশ্চিম

লোকসানের সময় দীর্ঘ হচ্ছে ছোট খামারিদের

অনলাইন ডেক্স রির্পোট
  • আপডেট টাইম: রবিবার, ৪ মে, ২০২৫
  • ১৩ বার পঠিত

টানা চার বছর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত ডিমের দাম ভোক্তার কাছে সহনীয় ছিল। কিন্তু প্রান্তিক খামারিদের এই সময়ে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে ডিম বিক্রি করতে হয়েছে। এ বছর ঈদুল ফিতরের পর এক মাস পার হলেও ডিমের দাম খুব একটা বাড়েনি। ফলে লোকসানের সময় লম্বা হচ্ছে ছোট ও মাঝারি খামারিদের। একই অবস্থা মুরগির মাংসের ক্ষেত্রেও। সরকার বলছে, মুরগির খাবারের দাম বেশি হওয়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আর খামারিরা বলছেন, ডিম সংরক্ষণের সুযোগ থাকলে তাদের লোকসান গুনতে হতো না।
সাইফুল ইসলাম ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। রাজশাহীর পবা উপজেলার কাটাখালীতে তাঁর খামারে প্রতিদিন ডিম উৎপাদন হয় ১০ হাজার। ডিমপ্রতি উৎপাদন খরচ ১০ টাকা ১৯ পয়সা। সরকার ডিমের দাম ১০ টাকা ৫৮ পয়সা নির্ধারণ করলেও সাইফুল গেল শীত ও রোজায় বিক্রি করেন সর্বোচ্চ সাড়ে সাত টাকা দরে। খামার পর্যায়ে দাম এখন একই রকম। হিমাগারে ডিম রাখায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় ক্ষুদ্র খামারিদের বিপদ আরও বেড়েছে।

ক্ষুব্ধ সাইফুল বললেন, ‘দাম বাড়লে খামারিরা হয়ে যান দাগি আসামি! দিনের পর দিন গচ্চা দিচ্ছি, এখন কেউ দেখছে না।’ বেশি দামে মুরগির বাচ্চা ও খাবার কিনে সাইফুলের মতো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা খামার  চালাতে লোকসান গুনছেন। ভোক্তার পাতে সস্তায় ডিম-মুরগি পৌঁছে দিয়ে এখন নিজেরাই পড়েছেন সংকটে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রান্তিক খামারিরা ন্যায্যমূল্য না পেলে ডিমের উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। লাখো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বেকার হবে। তাদের সুরক্ষায় সরকারকে এখনই স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।ওয়ার্ল্ডস পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ শাখার (ওয়াপসা-বিবি) সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, রমজানের ২১ দিনে খামারিদের ১৫৯ থেকে ২০৬ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। বছরে তিন থেকে চারবার ডিম-মুরগির দর পতন হচ্ছে। এতে অনেকে সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসছেন।

মসিউর রহমান বলেন, খামারিদের সুরক্ষায় স্বল্প সুদে ঋণ নিশ্চিত করা জরুরি। সরকারিভাবে ডিম-মুরগির সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ, কোল্ডস্টোরেজে ডিম সংরক্ষণের বাধা দূর করা দরকার। দর পতনের সময় প্রান্তিক খামারিদের ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে।রোজা শুরু হয়েছিল ২ মার্চ। তার আগের প্রায় এক মাস ডিমের হালি ছিল ৪৫-৫০ টাকা। ১৬ মার্চ ১৫ রোজায় তা নেমে আসে ৩৮-৪৫ টাকায়। ২০২৪ সালে রোজা শুরু হয়েছিল ১২ মার্চ। টিসিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেবার রোজা শুরুর এক মাস আগে রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি হালি ডিমের দাম ছিল ৪৪-৪৭ টাকা। ১৫ রোজা পার হতে না হতে দাম কমে হয় ৪০-৪৩ টাকা। রোজা শেষে আগের দামে ফেরে ডিম। একই প্রবণতা ২০২২ সাল থেকে চলে আসছে।

এবারের চিত্র ভিন্ন। ঈদুল ফিতরের এক মাস পরও খুচরা বাজারে ডিম বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা হালি। এতে ভোক্তা পর্যায়ে স্বস্তি থাকলেও বিপাকে পড়েছেন খামারিরা। তাদের ভাষ্য, উৎপাদন খরচের চেয়ে প্রতি পিস ডিমে আড়াই থেকে তিন টাকা লোকসান দিচ্ছেন।

গত বছর উৎপাদন খরচ বিবেচনায় খামারি পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের দাম ১০ টাকা ৫৮ পয়সা নির্ধারণ করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। পরে মূল্য সমন্বয়ের কথা থাকলেও তা হয়নি। বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিআইএ) মহাসচিব খন্দকার মুহাম্মদ মহসিন বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে দিনে গড়ে ডিমের চাহিদা পাঁচ কোটি। রোজায় তা এক-তৃতীয়াংশ কমে যায়। ভারতে ৮ থেকে ১৩ ডিগ্রি তাপমাত্রায় এক বছর পর্যন্ত ডিম সংরক্ষণ করা হয়। বাংলাদেশেও এমন হিমাগার তৈরির প্রস্তাব দিয়েছি প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে। এটি বাস্তবায়ন হলে সারাবছর একই দামে ভোক্তাকে ডিম খাওয়ানো যাবে; খামারিরাও লাভবান হবেন।’

খন্দকার মুহাম্মদ মহসিন বলেন, ‘বর্তমানে প্রান্তিক খামারিরা প্রতি কেজি ব্রয়লার বিক্রি করছেন ১৫০-১৬০ টাকায়। অথচ তাদের উৎপাদন খরচ ১৭০-১৮০ টাকা। লোকসান দিয়ে কতদিন টিকবেন খামারিরা, সেটিই বড় প্রশ্ন।’

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য, দেশে ছোট-বড় পোলট্রি খামার প্রায় এক লাখ। এর ১০ শতাংশ বড় খামারি। সরাসরি ২৫ লাখসহ পরোক্ষভাবে এ শিল্পে শ্রম দিচ্ছেন ৬০ লাখের বেশি মানুষ। দৈনিক চার থেকে সাড়ে চার কোটি পিস ডিম উৎপাদন হয়। বছরে ১১ লাখ টন মাংস উৎপাদন হচ্ছে। শুধু ডিম-মাংস উৎপাদন নয়; বাচ্চা, খাদ্য, ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রি মিলে এ খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ।

দুই বছর ব্যবধানে খাদ্য, ওষুধ, বাচ্চা, পোলট্রি উপকরণসহ আনুষঙ্গিক সবকিছুর দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বিপরীতে ডিম-মাংসের দাম কমে যাওয়ায় ভাঁজ পড়েছে খামারিদের কপালে। কুমিল্লার দাউদকান্দির হাসানপুর গ্রামের খামারি আমানুল হক জানান, ২০২২ সালে ১৫-২০ টাকার লেয়ার বাচ্চা এখন কিনছেন ৭০-৭৫। ২০-২৫ টাকার ব্রয়লার বাচ্চায় লাগছে ৬৫-৭০। দ্বিগুণ বেড়ে সোনালি জাতের বাচ্চা কিনছেন ৫০ টাকায়। ২৫ টাকা কেজির বেডিফিট হয়েছে ৩৫-৪০; ১৫ টাকা কেজির ভুট্টা ৩৫। সয়াবিন ৩০ থেকে ৬০ টাকা, মিটবোন মিল ৩৫ থেকে হয়েছে ৭০ টাকা।

ঝালকাঠির নলছিটির সুবিদপুর ইউনিয়নের খামারি সেলিম খান বলেন, ‘গেল শীত ও রোজায় এক হাজার মুরগিতে বিনিয়োগ করে ৩০ হাজার টাকা লোকসান দিয়েছি। এখন ব্যবসা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’

কক্সবাজারের চকরিয়ার ঢেমুশিয়া ইউনিয়নের প্রান্তিক খামারি ছমির উদ্দিন জানান, একটি বয়লার মুরগি এক কেজি ওজন করতে খরচ ১৬৫-১৭০ টাকা। অথচ পাইকারিতে ১৪০-১৫০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।

অ্যানিমেল হেলথ কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আহকাব) সাধারণ সম্পাদক আফতাব আলম বলেন, ‘ডিমের দাম বেশি ছিল বলে সরকার আমদানির অনুমতি দিয়েছিল। চাহিদা কমের সময় সরকারের উচিত রপ্তানি করে খামারিদের সুরক্ষা দেওয়া।প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মুরগি উৎপাদনের ১০ শতাংশ আসে দেশের ১০ বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে। বাকি ৯০ শতাংশের জোগান দেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা। ক্ষুদ্র খামারিরা লোকসান গুনলেও মুনাফা করছেন করপোরেট খামারিরা।গাজীপুরের ক্ষুদ্র খামারি আবদুর রহমান বলেন, বড় বড় কোম্পানি ডিম-মুরগির পাশাপাশি বাচ্চা, খাদ্য, ওষুধসহ সব রকম পোলট্রি উপকরণ উৎপাদন করে। এতে তাদের ডিম ও মুরগি উৎপাদনে খরচ কম হয়। বিপরীতে ক্ষুদ্র খামারিরা করপোরেট প্রতিষ্ঠান থেকেই বাচ্চা, খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ কেনে। আবার সংরক্ষণ ও বাজার ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ না থাকায় ছোট খামারিরা কুলিয়ে উঠতে পারছে না।

কাজী ফার্মসের পরিচালক কাজী জাহিন হাসানের দাবি, প্রান্তিক খামারিরা কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে আশাতীত উপকৃত হচ্ছেন। জীবিত মুরগির জন্য খামারিরা গ্রোয়িং চার্জ পাচ্ছেন। ব্রয়লার মুরগির দর পতন হলে খামারি নন, ক্ষতি বহন করছে কোম্পানি। এর পরও কোনো কারণে সন্তুষ্ট না হলে পরবর্তী ব্যাচ থেকে খামারিদের স্বাধীনভাবে ব্যবসা করার সুযোগ রয়েছে।ঢাকার কেরানীগঞ্জের ক্ষুদ্র খামারিরা জানান, বাচ্চা পালন থেকে শুরু করে বাজারে মুরগি বিক্রি করা পর্যন্ত নানাভাবে তারা শোষণের শিকার হচ্ছেন। নিজস্ব বিনিয়োগ কম থাকায় স্থানীয় ডিলারের কাছ থেকে বাচ্চা, খাবার ও ওষুধ বাকিতে কেনেন বাড়তি দামে। শর্ত অনুযায়ী ডিলারের কাছে বিক্রি করতে হয় মুরগি। শর্তের বেড়াজালে ডিলাররা ইচ্ছামতো দাম দেন ও পাওনা কেটে রাখেন।

তাদের ভাষ্য, বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান অফিস খুলে ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং’-এর নামে ডিলারের মতো বাচ্চা, খাবার ও ওষুধ সরবরাহ করছে। বাচ্চাগুলো মুরগি হয়ে উঠলে কোম্পানিগুলো বাজারদরে কিনে নিচ্ছে। এতে লাভের বড় অংশ কোম্পানি ও ডিলারের পকেটে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র খামারিরা শুধু ‘গ্রোয়িং চার্জ’ বা বাচ্চা বড় করার মজুরি পাচ্ছেন।

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের সুফল হলো উৎপাদন খরচ কমছে। কিন্তু খামারিদের এ মুরগি বাজারজাতের স্বাধীনতা নেই। প্রান্তিক খামারিদের রক্ষায় খাদ্য ও বাচ্চার দাম প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে সার্বক্ষণিক মনিটর করতে হবে। বিদ্যুৎ বিল কৃষির হারে নিতে হবে। জটিল রোগের টিকা ও ওষুধ বিনামূল্যে দিতে হবে। খামারিদের সমিতির আওতায় এনে জামানত ছাড়া ঋণের ব্যবস্থা করা জরুরি।প্রতিটি উপজেলার প্রধান বা বড় বাজারে সমিতির নামে দু-তিন শতক জায়গায় মুরগি ও ডিম বিক্রির দোকান নির্মাণ করে দিলে খামারিরা সরাসরি পণ্য বাজারজাত করার সুযোগ পাবেন বলে জানান তিনি।এ ব্যাপারে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, ‘ফিডেই খামারিদের ব্যয় হচ্ছে ৭০ শতাংশ। তাই খাদ্য উৎপাদন খরচ কমাতে উদ্যোগ নেওয়া হবে।’ পোলট্রি খাতের পণ্য আমদানিতে ট্যাক্স কমানোর ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমদানি পণ্যে বেশি ট্যাক্স নেওয়া হচ্ছে। এটি কীভাবে কমানো যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।’

নিউজটি শেয়ার করুন..

  • Print
  • উত্তরা নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন:
এ জাতীয় আরো খবর..
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৩-২০২৫ | Technical Support: Uttara News Team
themesba-lates1749691102