চলতি বছরের শেষে অথবা জানুয়ারির শুরুতে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে বিদেশিদের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয় তা নিয়ে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন বারবার।
তারই অংশ হিসেবে আসন্ন নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়টি মূল্যায়নে প্রাক-মিশনে নামছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। রোববার (৯ জুলাই) থেকে ইইউর ছয় সদস্যের স্বাধীন বিশেষজ্ঞ দলটি তাদের কার্যক্রম শুরু করবে।
দুই সপ্তাহ তারা বাংলাদেশ অবস্থান করবে। এ সময়ে বিশেষজ্ঞ দলটি ঢাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের সঙ্গে মতবিনিময় করবে। তারা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বিশেষজ্ঞ দলটি তাদের মূল্যায়ন ও মতামত জমা দেবে ইইউর পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেলের কাছে। তাদের মতামত ইতিবাচক হলে পরবর্তী সময়ে আরও প্রতিনিধিদল পাঠাবে ইইউ। সবকিছু ঠিক থাকলে অর্থাৎ প্রতিনিধিদলের মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানো হবে কি না, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন ইইউপ্রধান।
নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে ইইউর বিশেষজ্ঞ দলটির এ সফর হওয়ায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তেমন কিছু করণীয় নেই। তবে, দলটির ঢাকা মিশনকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে কূটনীতিকরা। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বেশ সরব। পশ্চিমাদের নির্বাচন নিয়ে যে সরব অবস্থান সেটাকে খাটো করে দেখা ঠিক হবে না। এছাড়া ইইউর প্রতিনিধিদল যদি ভালো রিপোর্ট দেয় তবেই তারা নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবে। সেজন্য তাদের এ সফরকে গুরুত্ব না দেওয়ার উপায় নাই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শেষ পর্যন্ত যদি ইইউ চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠায়, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে পশ্চিমারা। সেজন্য প্রাথমিক যে দলটি আসছে, তাদের মতামত জরুরি।
ইইউর ঢাকা অফিসের দেওয়া তথ্য বলছে, ছয় সদস্যের স্বাধীন বিশেষজ্ঞ দলের দুজন শনিবার (৮ জুলাই) সন্ধ্যায় ঢাকায় পা রেখেছেন। বাকি চারজনের মধ্যরাতে ঢাকায় নামার কথা রয়েছে। রোববার (৯ জুলাই) নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু হবে তাদের ঢাকা মিশন।
দলটির কাজ হবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশনের কর্মপরিধি, পরিকল্পনা, বাজেট, লজিস্টিকস ও নিরাপত্তা বিষয়ে মূল্যায়ন করা। দলটি বাংলাদেশে অবস্থানকালে সরকারের প্রতিনিধি, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, শেষ পর্যন্ত ইইউর চূড়ান্ত দল যদি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে বাংলাদেশে না আসে, তবে দেশের ক্ষতি হবে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে বলে তখন আর বলা যাবে না। তাদের প্রতিবেদন ইতিবাচক হলেই ইইউর চূড়ান্ত দল নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে বাংলাদেশে আসবে। সুতরাং তাদের এ সফর বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে, শনিবার (৮ জুলাই) ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ডিক্যাব)-এর এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষক আসতে চাইলে স্বাগত জানানো হবে।
তিনি বলেন, নির্বাচন পর্যবেক্ষক এলে ভালো, কিন্তু না এলে আমরা পরোয়া করি না।
‘নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না এলেও সেটি দেশের ক্ষতির কারণ হবে না’ মন্তব্য করে মোমেন বলেন, ‘দুনিয়ার বড় বড় দেশে নির্বাচন দেখার জন্য কোনো পর্যবেক্ষক যায় না। আমাদের দেশে পর্যবেক্ষক এলো কি এলো না, এতে কিছু যায় আসে? বিদেশি পর্যবেক্ষক যদি আসতে চায়, তবে আমাদের আপত্তি নেই।’
‘আমাদের দেশে একটি সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে বিদেশিদের এনে এনে নির্বাচন দেখানো। আমার মতে, এটি ভবিষ্যতে বন্ধ করা দরকার। আমাদের দেশে অনেক বাড়তি কাজ হচ্ছে এবং এটি বন্ধ করা উচিত।’
ইইউর বিশেষজ্ঞ দলের ঢাকা পা ফেলার কয়েক ঘণ্টা আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জ্যেষ্ঠ এক কূটনীতিক বলেন, নির্বাচন নিয়ে বিদেশিরা খুব নজর রাখছে। পশ্চিমারা প্রতিনিয়ত বক্তব্যও দিচ্ছে। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করার জন্য হলেও আমাদের বিদেশি পর্যবেক্ষকদের স্বাগত জানানো উচিত। আমাদের যারা নীতিনির্ধারক আছেন তাদের হিসেব করে কথা বলা দরকার।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ইইউ অনেক দিন ধরে বাংলাদেশ ইস্যুতে সরব। তারা যেসব বিষয়ে অসংগতি দেখছে, কথা বলছে…, ইদানিং যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু খুব সরব, সেক্ষেত্রে আমাদের তাদের পালসটা ধরতে হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র কোনো সিদ্ধান্ত নিলে ইইউ কিন্তু তাদের পক্ষেই মত দেবে।’
উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক দল পাঠিয়েছিল ইইউ। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক নয় বলে সেবার পর্যবেক্ষক দল পাঠায়নি ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সর্বশেষ, ২০১৮ সালের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন ইইউর পর্যবেক্ষক দলকে পর্যবেক্ষণের জন্য আমন্ত্রণ জানায়নি।