বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২০ অপরাহ্ন

বিজয়ের মাসে বিক্ষিপ্ত ভাবনা

উত্তরা নিউজ ডেস্ক
  • আপডেট টাইম: শনিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২২
  • ৩৫১ বার পঠিত

‘কী পাইনি তার হিসাব মেলাতে মন মোর নহে রাজি’—যে জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনীর পেটে দুইবেলা মোটামুটি দুমুঠো ভালো-মন্দ ঠিকই পড়ে তার কণ্ঠে এমন সঙ্গীত অবশ্যই বেমানান নয়। কিন্তু যে অভাগা বা অভাগীর কপালে তা তো জোটেই না, উল্টো নিয়মিত বরাদ্দ জোটে লাথি-গুঁতোর, সে তো নিশ্চয়ই হিসাব চাইবে তারই পাট বেচা টাকার, ভিক্ষার্জিত কাঁড়া-আঁকাড়া চাল-গমের, তার ‘পায়ের ঘাম মাথায় তুলে’ অর্জিত দুটো পয়সার। সে হিসাব না দিয়ে যদি গাঁটছড়া বাঁধার দিন থেকেই শুরু হয় অবহেলা-অবজ্ঞা আর নির্যাতন—তাহলে বঞ্চিত, নির্যাতিত, নিগৃহীত হতে হতে একদিন সেই কঙ্কালসার মূর্তি রুখে দাঁড়াবেই। প্রথমে প্রতিবাদ, তারপর প্রতিরোধের পালাশেষে সশস্ত্র যুদ্ধ।

সেই যুদ্ধের আগে নির্যাতিত-বঞ্চিতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত : তোমার সঙ্গে চিরতরে ছিন্ন করলাম এই অসম অযৌক্তিক ও অবাঞ্ছিত বন্ধন।

আমার মতো যাঁদের স্মরণে-সংবেদে পাকিস্তানের সঙ্গে দুই যুগ আনুষ্ঠানিকতা বজায় রেখে পথচলার দুঃসহ স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বল করে, তাঁরা জানেন প্রতারণা-বঞ্চনা-বৈষম্য কত প্রকার ও কী কী। উনিশ শ সাতচল্লিশের দেশভাগের আগে পাকিস্তানের রঙিন স্বপ্নে বিভোর পূর্ব বাংলার মানুষের মোহভঙ্গ যে এতো দ্রুত ঘটবে তা বোধ হয় তাদের নিবেদিতপ্রাণ শ্রদ্ধেয় নেতারাও কখনো কল্পনাও করতে পারেননি। পাকিস্তানের সাত কোটি মানুষের অর্ধেকেরও বেশির বাসভূমি ছিল পূর্ববঙ্গ, যার নাম রাতারাতি বদলিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা—যারা শুরু থেকেই ছিল চালকের আসনে-রাখলো পূর্ব পাকিস্তান। আর শুধু রাষ্ট্র পরিচালনাই নয়, প্রশাসন-উন্নয়ন-শিক্ষাদীক্ষা—সব কিছুতেই আগাগোড়া বঞ্চনার শিকার ছিল এই ভূখণ্ড। বিষয়টা ছিল এমন, যেন সুয়োরানি পশ্চিম পাকিস্তানের সব ধরনের ‘খাই’ মিটিয়ে উদ্বৃত্ত কিছু ছিটেফোঁটা থাকলে দুয়োরানি পূর্ব পাকিস্তানের গরিব-গুরবোদের জন্য লিল্লাহস্বরূপ পাঠিয়ে দাও। এহ বাহ্য। এর চেয়েও মারাত্মক অভিঘাত হানা হলো বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতির ওপর। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে চেষ্টা শুরু হলো পূর্ব বাংলার মানুষকে তথাকথিত ‘ইসলামি তমদ্দুনের’ জোশে উদ্ভাসিত করে তুলতে। বাংলার চিরায়ত কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে আখ্যায়িত করা হলো অনৈসলামিক বলে। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীর মাতৃভাষা বাংলাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে দিলেন। এরপরের ইতিহাস শুধু আমাদের বুকের রক্ত দিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস নয়, এটা সারা বিশ্বের ভাষা ও সংস্কৃতির এক অমেয় অম্লান অধ্যায়।

পশ্চিমারা গোড়াতেই যে জায়গাটাতে ভুল করল তা হচ্ছে উদার হৃদয়ের বাঙালি মুসলমানকে অধার্মিক ও হিন্দুধর্মপ্রিয় মনে করা। অথচ বাস্তবতা ছিল পাশ্চাত্য সংস্কৃতির স্তাবক এক শ্রেণির ‘আপস্টার্ট’ পশ্চিমাদের চেয়ে পূর্ব বাংলার বাঙালিরা ছিল অনেক অনেক বেশি ধর্মপরায়ণ। সেই সঙ্গে পরমতসহিষ্ণুতা, পরধর্মকে শ্রদ্ধা করা ছিল তাদের আজন্মলালিত কৃষ্টি-সংস্কৃতির অঙ্গ। এর বিপরীতে একজন পশ্চিম পাকিস্তানি, বিশেষ করে পাঞ্জাবি মুসলমানের কাছে একজন হিন্দু বা শিখ ছিল দুই চক্ষের বিষ। তার সংসর্গে বসবাস করা তার জন্য ছিল অকল্পনীয়। ফলে শুরু থেকে পাকিস্তানিরা বাঙালি মুসলমানদের জন্য এক ধরনের শুদ্ধি অভিযানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল।

এসব পাকিস্তানি মুসলমান নেতাফেতাদের সংস্কৃতির স্বরূপ বোধ হয় বিধৃত ছিল ওই চুটকিতে, যাতে বলা হয়েছে রমজান মাসে ইফতারের সময় এক লোককে দেখা গেল বরফশীতল বিয়ার দ্বারা জোরে বিসমিল্লাহ বলে রোজা ভাঙ্গতে, আর সেই সঙ্গে পানীয় পানকালে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ও মধ্যমা দ্বারা নিজের পুরুষ্টু গোঁফজোড়াকে ঈষৎ উঁচু করে ধরে রাখতে। একজন যখন ওই বিয়ার পানকারীকে জিগ্যেস করল ওভাবে গোঁফ উঁচু করে ধরার কারণ কি, তখন সে জবাব দিল, ‘তাকে বিয়ার মকরুহ না হো যায়ে। ’ অর্থাৎ গোঁফের ছোঁয়া লেগে যেন বিয়ার ‘মকরুহ’ না হয়ে যায়! এই ছিল বাঙালি মুসলমানদের বিশুদ্ধকরণ মিশনের লোকদের ইমান-আকিদা!

যাই হোক, অমা রজনীও একসময় শেষ হয়ে উদিত হয় বালার্ক। বাঙালি জীবনের দুঃখ-কষ্টও একদিন শেষ হয়। তবে তার আগে বাঙালিকে সব বাদ-বিসম্বাদ, তর্ক-বিতর্ক ভুলে গড়ে তুলতে হয় নিখাদ জাতীয় ঐক্য। সেটা সম্ভব হলো বাঙালিকে যখন সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে পশ্চিমা পাশবশক্তি তাদের ন্যায্য রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত করল তখন, ১৯৭০ সালে, যখন পশ্চিমারা বাঙালির প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়লাভের পরও সরকার গঠন করতে দিতে অস্বীকার করল তখন। এত বড় অন্যায়ের বিরুদ্ধে সারা বাংলাদেশে তীব্র আন্দোলন ছিল অনিবার্য। আর এর জবাবে পশ্চিমা শক্তি রাতের অন্ধকারে অকস্মাৎ অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে বন্দুক-কামানের গুলিতে হত্যা করল অগণিত নিরস্ত্র বাঙালি ছাত্র, পুলিশ ও সাধারণ মানুষকে। আর ওটাই ছিল ‘লাস্ট স্ট্র অন দ্য ক্যামেলস ব্যাক’-(মালভারে ন্যুব্জদেহ) উটের পিঠে সর্বশেষ খড়ের আঁটিটি। যে বাঙালি জাতিকে চিরকাল যুদ্ধভীতু জাতির অপবাদ শুনতে হয়েছে, তারাই একাত্তরে রণাঙ্গনে ৯ মাস অকাতরে জীবন বিসর্জন দিয়ে এক সম্পূর্ণ অসম যুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে আনে সর্বপ্রকার আধুনিক সমরসজ্জায় সজ্জিত ‘আসব বলে পাশবমত্ত’ (কবি বেনজির আহমদ, কবিতা : আমার সাগরে জেগেছে ঊর্মি। ) এক বিপুল সেনাবাহিনীর কাছ থেকে।

৩.

সেটা ছিল ডিসেম্বর ১৯৭১—আমাদের বিজয়ের মাস। আর ক’দিন পরেই উদযাপিত হবে ১৬ ডিসেম্বর-বিজয় দিবস। সেই মহান দিবসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে প্রতিবারের মতো সবার আগে আমরা গায়ক আব্দুল জব্বারের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে সালাম জানাই একাত্তরের বীর শহীদদের : ‘সালাম সালাম হাজার সালাম সকল শহীদ স্মরণে…। ’

আচ্ছা, এই সালামের জবাবে শহীদরা যদি জানতে চান, ‘আমরা আমাদের জীবন বিসর্জন দিয়ে যে জন্য স্বাধীনতার লাল সূর্যটাকে সেদিন ছিনিয়ে এনেছিলাম, হে আমাদের দেশবাসী, তা কি তোমরা অর্জন করতে পেরেছ? একাত্তরপূর্ব দুই যুগ যে বঞ্চনা, যে অন্যায়, অবিচার, যে দুর্নীতির শিকার ছিলাম আমরা, তা থেকে কি বাঙালি মুক্তি পেয়েছে? একাত্তরে যে ইস্পাতকঠিন ঐক্য পুরো জাতিকে একতাবদ্ধ করেছিল তখনকার আসুরিক শক্তির বিরুদ্ধে, সেই ঐক্য কি বর্তমানের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতি, সম্পদ পাচার, মিথ্যাচার ও নারী নির্যাতনের মতো কালসাপকে নির্মূল করার কাজে লাগানো যায় না? যে গণতন্ত্রের জন্য দেশের ছাত্র-জনতা সেদিন অকাতরে প্রাণ দিল, সেই গণতন্ত্রের সোনার হরিণ কি চিরকাল অধরাই থেকে যাবে সোনার বাংলাদেশে?’… একাত্তরের বীর শহীদদের হয়তো আরো অনেক কিছু জানার আছে। আর জানার অধিকার অবশ্যই আর কারো না থাক, তাদের আছে। কারণ আমরা ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারোর দানে পাওয়া নয়’ (গায়ক : অমর শিল্পী আব্দুল লতিফ)। আর এই দাম দিয়েছিল বুকের তরতাজা রক্ত দিয়ে একাত্তরের বীর শহীদরা। কাদের জন্য দিয়েছিল এই দাম, এই বুকের রক্ত? নিশ্চয়ই তাদের নিজেদের জন্য নয়। তারা তো রক্ত দিয়েই পৌঁছে গেছে শহীদি দরজায়, উপহার হিসেবে রেখে গেছে একগুচ্ছ রক্তকমলের মতো রক্তস্নাত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। আজ ডিসেম্বরে, মার্চে, ফেব্রুয়ারিতে, বস্তুত সারা বছরজুড়ে আমরা খুঁজে বেড়াই শহীদদের প্রশ্নের জবাব। দুই যুগের পাকিস্তানি দুঃশাসনের কবর তো হয়ে গেছে ৯ মাসের যুদ্ধে, ভালো কথা, কিন্তু তারপর যে দেখতে দেখতে আরো দুই যুগ নয়, অর্ধশতাব্দী পার হয়ে গেল, বাঙালি কি মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর মতো ঐক্যবদ্ধ থাকল জাতীয় মূলনীতির প্রশ্নে? দেশ থেকে দারিদ্র্য, বৈষম্য, অন্যায়-অবিচার দূর করার প্রশ্নে? নাকি দেশ দিন দিন অনৈক্যের দিকে, বিভাজন, মারামারি, হানাহানির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? আমাদের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের ক্ষেত্রে আমরা নিশ্চয়ই অনেক সাফল্য অর্জন করেছি। এগুলো খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। এ সব কিছুই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। হয়তো আরো পাবে। কিন্তু মূল্যবোধ? ন্যায়নীতি? সুবিচার? সুশাসন? এগুলোর কী হবে? আর কত দিন আমরা ট্রাক-বাস ভাড়া করে লোক জমায়েত করা, নানা ফন্দি-ফিকির করে প্রতিপক্ষের জমায়েত ভণ্ডুল করার অপচেষ্টা চালানো, ক্ষমতার রাজনীতি, পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদগার এবং সেই সঙ্গে কালো টাকার পাহাড় গড়ার দুঃস্বপ্নকে বাস্তবায়নে রাত-দিন ব্যস্ত থাকব? কেন আমাদের কোনো রাজনৈতিক সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষিত হলে দুশ্চিন্তায় সাধারণ মানুষের গায়ে জ্বর আসবে? কেন নির্বাচন এলে আমরা ভাবতে শুরু করি এবারও কি আমার ভোটটা অন্য কেউ দিয়ে দেবে?

৪.

সামনে ১৬ ডিসেম্বর—বিজয় দিবস। তার আগে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় এক বড় রাজনৈতিক দলের আহৃত গণসমাবেশ। এই দুই দিনের কথা মাথায় রেখে যেসব প্রশ্ন আমাকে ও পাঠককুলকে আন্দোলিত করে, মনে করি তারই কয়েকটি তুলে ধরলাম আজকের লেখায়। যদি জানতে চান এসবের সমাধান কী? আমি বলব, জানি না। তবে একাত্তরপূর্ব দুই যুগে বাঙালির আচরণ কেমন ছিল তা বিচার-বিশ্লেষণ করলে আমাদের বর্তমান অবয়ব বোধ হয় মনদর্পণে আরো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠবে।

লেখক : সাবেক সচিব, কবি
mkarim06@yahoo.com

নিউজটি শেয়ার করুন..

  • Print
  • উত্তরা নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন:
এ জাতীয় আরো খবর..
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৩-২০২৩
themesba-lates1749691102