ঋণের দায়ে পাবনার ১২ কৃষককে কারাগারে পাঠানোর প্রসঙ্গ টেনে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেছেন, মাত্র ২৫ হাজার টাকার জন্য সাধারণ কৃষকদের কোমরে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অথচ যাদের কাছে লক্ষ-কোটি টাকা পাওনা, তাদের কিছুই হয় না।
সোমবার (২৮ নভেম্বর) কোনো ব্যাংক ডিজঅনার মামলা করতে পারবে না, এ সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় স্থগিত আবেদনের শুনানিতে চেম্বার বিচারপতি এ মন্তব্য করেন।
শুনানির শুরুতে ব্র্যাক ব্যাংকের আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন আদালতকে বলেন, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হাইকোর্ট রায় দিয়ে বলেছেন, কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনারের মামলা করতে পারবে না। নিম্ন আদালতে এ সংক্রান্ত বিচারাধীন সব মামলায় স্থগিতাদেশ দিয়েছেন।
তখন চেম্বার বিচারপতি বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় না দেখে এ বিষয়ে আপাতত কিছু বলা যাবে না।
অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে চেম্বার আদালত বলেন, মাত্র ২৫ হাজার টাকার জন্য সাধারণ কৃষকদের কোমরে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অথচ যাদের কাছে লক্ষ-কোটি টাকা পাওনা, তাদের কিছু হয় না।
গ্রাহকের কাছ থেকে চেক নেওয়া প্রসঙ্গে বিচারপতি বলেন, এই চেকে কে স্বাক্ষর করে, কে টাকার অঙ্ক বসায়, কে কলাম পূরণ করে? তার কোনো হদিস নেই। এই চেক নেওয়া যাবে না বলে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, তারপরেও ব্যাংকগুলো কেন মানছে না?—প্রশ্ন রাখেন আদালত। পরে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের আবেদন শুনানির জন্য আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আগামী ১ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগে এ বিষয়ে শুনানি হবে।
এর আগে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ আদায়ের জন্য কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনার মামলা করতে পারবে না—এই রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে ব্র্যাক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
গত ২৩ নভেম্বর চেক ডিজঅনার মামলা সংক্রান্ত রায় দেন হাইকোর্ট। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ আদায়ের জন্য শুধুমাত্র ২০০৩ সালের অর্থঋণ আইনের বর্ণিত উপায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা করতে পারবে। পাশাপাশি বর্তমানে আদালতে চলমান ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়ের করা সব চেক ডিজঅনার মামলার কার্যক্রম বন্ধ থাকবে বলে রায়ে বলা হয়েছে।
ঋণ আদায়ের জন্য এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্র্যাক ব্যাংকের চেক ডিজঅনার মামলা বাতিল করে ২৩ নভেম্বর বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।
পরে ব্র্যাক ব্যাংকের আইনজীবী সাইফুজ্জামান তুহিন বলেন, ঋণ আদায়ের জন্য চেক ডিজঅনারের অভিযোগ তুলে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কারো বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে না। এ সংক্রান্ত সব মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেছেন আদালত। হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।
রায়ে আদালত বলেছেন, ব্যাংক ঋণের বিপরীতে যে চেক নিচ্ছে সেটা জামানত, বিনিময়যোগ্য দলিল নয়। জামানত হিসেবে রাখা সেই চেক দিয়ে চেক ডিজঅনার মামলা করা যাবে না।
আদালত বলেন, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ একটি চুক্তির মাধ্যমে নেওয়া হয়ে থাকে। ব্যাংকের কিছু দুর্নীতিবাজ, অসাধু কর্মকর্তা নিজেদের স্বার্থে তাদের হিডেন এজেন্ডা বাস্তবায়নে চেকের অপব্যবহার করে মামলা করে থাকে। তাদের ব্যবহার দাদন ব্যবসায়ীদের মতো। ঋণের বিপরীতে ব্ল্যাংক চেক নেওয়াটাই বেআইনি। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে এই বেআইনি কাজ করে আসছে।
রায়ে নিম্ন আদালতের প্রতি নির্দেশনা দিয়ে হাইকোর্ট বলেন, আজ থেকে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি চেক ডিজঅনার মামলা করে তাহলে আদালত তা সরাসরি খারিজ করে দেবেন। একইসঙ্গে তাদের ঋণ আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
আদালত বলেন, ব্যাংক হওয়ার কথা ছিল গরিবের বন্ধু, কিন্তু তা না হয়ে ব্যাংক ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গরিবের রক্ত চুষছে। এটা হতে পারে না। যারা হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হচ্ছে, ব্যাংক তাদের ঋণ মওকুফ করে দেয় এমন কথাও শুনি। কিন্তু কোনো গরিবের ঋণ মওকুফ করার কথা কোনোদিন শুনিনি। নীলকর চাষি ও দাদন ব্যবসায়ীদের মতো যেন-তেনভাবে ঋণ আদায় করাই তাদের লক্ষ্য। লোন আদায়ের জন্য অর্থঋণ আইনে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মামলা দায়ের না করে চেক ডিজঅনার মামলা করছে। এ কারণে আমাদের ক্রিমিনাল সিস্টেম প্রায় অকার্যকর হয়ে গেছে। তাই এখন থেকে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবে। অন্য কোনো আইনে নয়।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি হাইকোর্টের রায়ের আলোকে নির্দেশনা জারি করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এছাড়া সব ধরনের ঋণের বিপরীতে ইন্সুরেন্স কাভারেজ দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ খেলাপির মামলায় সম্প্রতি কারাগারে পাঠানো হয়েছিল ১২ জন কৃষককে। এ নিয়ে তুমুল সমালোচনার মধ্যে ওই ১২ জনসহ পরোয়ানাভুক্ত ৩৭ কৃষককে রোববার (২৭ নভেম্বর) জামিন দেন পাবনার একটি আদালত।