জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন বিশ্বদ্যিালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মো. হাসান অন্তর।
নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সন্তান হাসান অন্তর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বিজয়-২৪’ হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমন্বয়ক ছিলেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থীকে সংগঠিত করতে জোরালো ভূমিকা রাখেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
বাসস: জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। জুলাইয়ের সেই সংগ্রামী দিনগুলোর স্মৃতি এখন কেমন অনুভব করেন?
অন্তর: দিনগুলো খুব মনে পড়ে। যখন কোথাও যাই, ওই সময় দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। রোদ, বৃষ্টি, ঝুম বৃষ্টির মধ্যেও আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ধরে আন্দোলনে কাটিয়েছি। কখনো খেয়ে, আবার কখনো না খেয়ে দিনের পর দিন আন্দোলন করেছি। সেই স্মৃতিগুলো বড্ড মনে পড়ে। ভয় ও আশা নিয়ে প্রতিদিন আন্দোলনে বের হতাম। সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসতে পারবো, নাকি মারা যাবো, একটা ভয়ের মধ্যে প্রতিদিন আন্দোলনে যেতাম।
বাসস: কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত কীভাবে হয়েছিল?
অন্তর: কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ৪ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু করি। তার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন শুরু হয়। তাদের দেখাদেখি তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা বিভিন্ন গ্রুপে লেখালেখি করে। আমরাও অনুভব করি, আমাদেরও মাঠে নামা প্রয়োজন। তখন সবাই সিদ্ধান্ত নিই, ৪ তারিখ থেকে আমরা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন শুরু করব। প্রথমে আমরা ক্যাম্পাসে আন্দোলন করি, পরে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে মিছিল নিয়ে আমরা কোটবাড়ি বিশ্বরোড গিয়ে ব্লকেট কর্মসূচি পালন করি। সেই দিন থেকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় রেগুলার আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। আমরাই প্রথম দেশের লাইফলাইন খ্যাত ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে ব্লকেট কর্মসূচি পালন করি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।
বাসস: আপনারা কি শুরুতে জানতেন, এই আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেবে?
অন্তর: না। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। আমাদের দাবি ছিল, ২০১৮ সালে কোটা বাতিল করে যে পরিপত্র জারি করা হয়েছিল, সেটা পুনর্বহাল করতে হবে।
বাসস: কোটা সংস্কার আন্দোলনে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কেমন ছিল?
অন্তর: কোটা সংস্কার আন্দোলনে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জেলার অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে অংশ নেয়। দেশের জন্য শহীদ হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি আমাদের সবারই ছিল। আমরা জানতাম— এই আন্দোলন সহজ হবে না। কিন্তু ন্যায়ের জন্য লড়াই করতেই হবে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কেবল রাজনৈতিক নয়, মানবিক অধিকারের প্রশ্নেও এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কুবির শিক্ষার্থীরা সেই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন এক ইতিহাস তৈরি করেন।
বাসস: ক্যাম্পাসে সহিংসতা কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কোন দিকে নিয়ে যায়?
অন্তর: ক্যাম্পাসে সরকারের পেটুয়া বাহিনী শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনে হামলা চালায়। ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীর ওপর নির্যাতন শুরু করে, নানাভাবে হেনস্তা করে। ফলে শিক্ষার্থীরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তখন তারা ন্যায্য দাবি আদায়ে আরও শক্তি সামর্থ্য নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। পরে দিন দিন এর পরিধি বাড়তে থাকে।
বাসস: আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা সাধারণ শিক্ষার্থীদের কীভাবে প্রভাবিত করেছিল?
অন্তর: জুলাইয়ের ১৫ তারিখে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা করে, মারধর করে। এতে বাকি শিক্ষার্থীরা ক্ষেপে যায় এবং হামলার সাথে জড়িতদের আমরা হল থেকে বের করে দিই। হামলাকারীদের সবাই বয়কট করে।
বাসস: আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কেমন ছিল?
অন্তর: আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীরা ছিল আমাদের ঢাল এবং প্রেরণার অংশ। তারা ক্যাম্পাসের বাইরেও মহাসড়কে রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে দিন রাত আমাদের পাশে ছিল। অনেক আহত ও রক্তাক্ত হয়েছে। তারপরও তারা আমাদের সাথে রাজপথে থেকেছে ।
বাসস: ক্যাম্পাস ও আবাসিক হল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের ধারাবাহিকতা কেমন ছিল?
অন্তর: ক্যাম্পাস ও আবাসিক হল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্থান থেকে এসে আন্দোলন গতিশীল রাখে। সরকার পতনের আন্দোলনের সূত্রপাত মূলত ২৯ জুলাই শুরু হয়। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা ওইদিনই হাসিনার পতনের সুর তোলে।
বাসস: ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচি আন্দোলনে কেমন প্রভাব ফেলেছিল?
অন্তর: ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ আমাদের জন্য কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং ছিল। কারণ এই মহাসড়ক দেশের লাইফলাইন হিসেবে খ্যাত। অনেক বাধা এসেছে, তবুও আমরা দাবি আদায়ে অনড় ছিলাম। আমরা সারিবদ্ধ হয়ে রাস্তার মধ্যে বসে থাকতাম। হামলা, গুলি উপেক্ষা করে রোদ বৃষ্টিতে রাস্তায় অবস্থান নিয়েছিলাম।
বাসস: স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনসমূহের নেতাকর্মীদের কীভাবে মোকাবিলা করেছিলেন?
অন্তর: ২৯ জুলাই বিকেল ৩টার দিকে ক্যাম্পাসে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে আসার পথে কোটবাড়ি থেকে শুরু করে প্রতিটি পয়েন্টে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা অবস্থান নিয়েছিল। এক পর্যায়ে তারা আমাদের ওপর হামলা চালায়। এতে শিক্ষার্থীসহ অনেক সাধারণ মানুষ আহত হন। তারা মহাসড়কে আসার প্রতিটি শাখা সড়কের অবস্থান নিয়ে চলাচলকারীদের তল্লাশি চালাতো। ওই দিন আমাদের অনেক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে আহত করা হয়।
বাসস: আন্দোলন চলাকালে আপনি কী ধরনের হুমকির সম্মুখীন হয়েছিলেন?
অন্তর: আন্দোলনের সময় আমাকে বলা হয়েছে, আমার পড়াশোনা বরবাদ করে দেবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পারব না, মেরে ফেলবে- এই ধরনের হুমকি দিয়েছিল।
বাসস: আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের জন্য আপনারা কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?
অন্তর: শহীদ পরিবারকে সহযোগিতা, নিয়মিত যোগাযোগ রাখার পাশাপাশি আমরা কেন্দ্রীয় নেতাদের এ বিষয়ে সহযোগিতার অনুরোধ করেছি। এছাড়া শহীদদের স্মরণে দোয়ার আয়োজন ও তাদের কবর জিয়ারত করা হয়।
বাসস: আন্দোলনে ক্যাম্পাসের সাংবাদিকদের ভূমিকা কেমন ছিল?
অন্তর: আন্দোলনের সময় ক্যাম্পাসে সাংবাদিকদের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। তারাও আমাদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং নিয়মিত অনলাইনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করে আমাদের আন্দোলনকে আরও গতিশীল রাখেন।
বাসস: বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের ভূমিকা কেমন ছিল?
অন্তর: তারা শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলেন না এবং শিক্ষার্থীদের কোনো কাজের দায় ওনারা নেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন।
বাসস: বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা কেমন ছিল?
অন্তর: বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং পুলিশের ভূমিকা ছিল অসহযোগিতামূলক। পুলিশ আমাদের ওপর হামলা চালালেও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়।
বাসস: বিশ্ববিদ্যালয় ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা?
অন্তর: যে স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল, তা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।
বাসস: জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে আপনার প্রত্যাশা কী?
অন্তর: সাম্যের বাংলাদেশ দেখতে চাই।
বাসস: আপনাকে ধন্যবাদ ।
অন্তর: বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা এবং আপনাকেও ধন্যবাদ ।