যে সড়কের নিচে শুয়ে আছে খানিকটা ‘৭১
অনলাইন ডেক্স রির্পোট
-
আপডেট টাইম:
সোমবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৫
আধা-কাঁচা, আধা-পাকা ইদিলকাঠী সড়ক একেবারেই সাধারণ। সড়কটি ধরে মোটরসাইকেল চলে, ভ্যান চলে, মাঝে মাঝে লেগুনা বাসও চলে। তখন ধুলো ওড়ে, চাকার শব্দ মিলিয়ে যায় বাতাসে। এই পথের ইতিহাস অনেকেই জানে না, তাই কেউ থামেও না।পিরোজপুরের স্বরূপকাঠী উপজেলার জলাবাড়ী ইউনিয়নের ইদিলকাঠী বাজারসংলগ্ন এই পথের ঠিক নিচেই শুয়ে আছে ১৯৭১। শুয়ে আছে অগণিত মানুষ। যাঁরা শুধু নামহীন নন, ঠিকানাবিহীনও। তাদের অনেকেই আবার কবরহীন।সন্ধ্যা নদী ধরে তারা স্রোসে ভেসে গিয়েছিলেন। সেই সন্ধ্যা নদীরতীরের উপজেলা (নেছারাবাদ) স্বরূপকাঠী। স্বাধীনতার দু’দিন পর যে জনপদ শত্রুমুক্ত হয়েছিল, সেখানে আজ ইতিহাস চাপা পড়ে আছে মাটির নিচে। ক্যালেন্ডারে প্রতিবছর ১৮ ডিসেম্বর আসে।পতাকা ওড়ে, আলোচনাসভা হয়, মাঝে মাঝে মোমবাতি জ্বলে। কিন্তু সেই দিনের নিচেই লুকিয়ে থাকে আরেকটি সময়, যেটি রক্তে লেখা, অথচ অযত্নে পড়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বরূপকাঠী ছিল পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের শক্ত ঘাঁটি। নদী, খাল, বিল আর সড়কজুড়ে ছিল আতঙ্ক। উপজেলার অন্তত ২৪টি স্থানে সংঘর্ষ হয়েছিল।গুলিতে শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা, প্রাণ হারান নিরস্ত্র মানুষও। ’৭১-এর ১৮ ডিসেম্বর যুদ্ধ থেমেছিল, কিন্তু তাঁদের গল্প থামেনি। শুধু সেই গল্প শোনার মানুষ কমে গেছে। স্বরূপকাঠী মুক্ত দিবস উপলক্ষে সম্প্রতি একটি আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ এবং নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পৌঁছে দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেন। আলোচনা শেষে ১৯৭১ সালে বর্বর হামলায় নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয়া করা হয়, প্রজ্বালন করা হয় মোমবাতি।অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন শিক্ষক মাহফুজুর রহমান ফাগুন, মো. কবির হোসেন, চেতনা পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও কুড়িগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. জাহিদ সোহেল এবং ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন স্বরূপকাঠী (ট্যুয়াস)-এর সভাপতি মো. আসাদুজ্জামান। সভাপতিত্ব করেন চেতনা পরিষদ স্বরূপকাঠী উপজেলা সভাপতি মো. মাইনুল হক মিঠু।বক্তারা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ২৫ মার্চের গভীর অন্ধকারে ইদিলকাঠী গ্রামে শুরু হয় আগুন আর চিৎকার। দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে ঘরবাড়ি। কয়েক শ’ মানুষকে হত্যা করে লাশ ফেলে দেওয়া হয় খালে। খালের পাড়ে জমে ওঠে লাশের স্তূপ। তাড়াহুড়োয় ইদিলকাঠী বাজারসংলগ্ন সড়কের পাশে মাটিচাপা দেওয়া হয় লাশগুলো। সেই বধ্যভূমিটি আজও অরক্ষিত। প্রতিদিন পথচারীরা পাশ দিয়ে হাঁটেন। কিন্তু জানেন না, তাদের পায়ের নিচে কত মানুষের শেষ নিশ্বাস জমে আছে।বরছাকাঠিতে মৃত্যু এসেছিল আরো নির্মমভাবে। ১০ নভেম্বর ২৬ জনকে এক দড়িতে বেঁধে গুলি করা হয়। পাঁচজন কোনোভাবে প্রাণে বেঁচে যান। বাকিরা পড়ে থাকেন মাটিতে। পরদিন গ্রামবাসী সাতজনকে গোসল বা দাফনের কাপড় ছাড়াই একটি গর্তে মাটিচাপা দেন। সরকারি নথিতে জায়গাটি পরিচিত হয়ে যায় ‘সাত ব্যক্তির এক কবর’ নামে। বাকি ১৪ জনের না কাগজে, না মাটিতে- কোথাও কোনো চিহ্ন নেই তাঁদের।কুড়িয়ানা বাজারের পাশের দুটি ডোবায় একসময় ফেলা হয়েছিল আড়াই শ’ মানুষের লাশ। দুই দিন পর গ্রামবাসী কোনোরকমে সেগুলো মাটি চাপা দেন। সরকারি নথিতে জায়গাটি বধ্যভূমি হিসেবে চিহ্নিত থাকলেও, বাস্তবে নেই কোনো ফলক; নেই রক্ষাপ্রাচীর। বধ্যভূমির জমির মালিকানা বদলেছে, কিন্তু স্মৃতিগুলো বদলায়নি—সেগুলো শুধু মাটির নিচে চাপা পড়েছে।আটঘর কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগান ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় আশ্রয়ের জায়গা। মানুষ সেখানে লুকিয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধারা নিয়েছিলেন প্রশিক্ষণ। পাকিস্তানি সেনারা টানা ২১ দিন সেই বাগান লক্ষ্য করে আক্রমণ চালায়। পাল্টা আক্রমণে পাকবাহিনীর তিনজন সেনা নিহত হয়। কিন্তু সেই বাগানে কত নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, তার কোনো হিসাব নেই। আজ বাগান আছে, সারি সারি পেয়ারা গাছ আছে; কিন্তু নেই ইতিহাস চর্চা। শুধু নীরব সাক্ষী হয়ে এখনো গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে।প্রবীণদের মুখে আজও ভেসে আসে সন্ধ্যা নদীর কথা। স্রোতের সঙ্গে ভেসে যাওয়া লাশের কথা। এখনো তাঁদের চোখে ভাসে শকুন, কুকুর আর শেয়ালের কামড়ে ক্ষতবিক্ষত দেহগুলো। মানুষের হাতে মানুষ হত্যার পর প্রকৃতির সেই নির্মম দৃশ্যও ’৭১-এর নৃশংসতার অংশ- যে দুঃসহ স্মৃতি তাদের কাঁদায় আজও। বক্তারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ না করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানবে না, কীভাবে এই দেশ জন্ম নিয়েছিল। আর ততদিন পর্যন্ত, যেখানে গাড়ি চলে, সেখানেই শুয়ে থাকবে ’৭১।
নিউজটি শেয়ার করুন..
-
-
-
- Print
- উত্তরা নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন:
এ জাতীয় আরো খবর..