প্রথমেই বুঝে নেওয়া জরুরি, মাইক বা লাউডস্পিকার ব্যবহার কোনো ইবাদত নয়, বরং এটি একটি সহায়ক উপকরণ মাত্র।শরিয়ত কোথাও খুতবা, নামাজ বা ওয়াজের জন্য মাইক ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করেনি। কাজেই এর ব্যবহার হবে প্রয়োজন অনুযায়ী, এর বেশি নয়।আজানের ক্ষেত্রে দূর পর্যন্ত আওয়াজ পৌঁছানো একটি স্বীকৃত ও প্রয়োজনীয় বিষয়। কিন্তু ওয়াজ-নসিহত, বয়ান, খুতবা, কোরআন তিলাওয়াত বা জিকিরের আওয়াজ ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায় পৌঁছে দেওয়ার কোনো ইসলামী বাধ্যবাধকতা নেই।
ইসলামের মৌলিক নীতি হলো, ‘কেউ যেন অপরের জন্য কষ্টের কারণ না হয়।’ ফিকহের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ আল-বাহরুর রায়েকে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘ইমাম যদি মুসল্লিদের প্রয়োজনের সীমা অতিক্রম করে উচ্চৈঃস্বরে কিরাত করেন, তবে তিনি ভুল করেছেন।’ (১/৩৩৭)। অর্থাৎ প্রয়োজনের অতিরিক্ত উচ্চ আওয়াজ নিজেই ইসলামের দৃষ্টিতে একটি ত্রুটি।বাস্তবেও আমরা দেখি, বাইরের বড় লাউডস্পিকারের উচ্চ শব্দের কারণে আশপাশের নারী, বৃদ্ধ, রোগী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, এমনকি শিশু ও গর্ভবতী নারীরাও চরম কষ্টে পড়েন। অনেক সময় তাঁরা নিজের ঘরে শান্তিতে নামাজ পড়তে, জিকির করতে বা বিশ্রাম নিতেও পারেন না। অথচ কারো ইবাদতে বিঘ্ন সৃষ্টি করা যে গুনাহ, এ বিষয়ে শরিয়তের অবস্থান একেবারেই স্পষ্ট।
সাহাবায়ে কেরামের যুগে শব্দ-সংযমের শিক্ষা
ইতিহাস আমাদের শেখায়, শব্দ-সংযম ইসলামী সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস উমর ইবনু শায়বা (রহ.) বর্ণনা করেন, মদিনায় এক ব্যক্তি আয়েশা (রা.)-এর ঘরের নিকটে উচ্চৈঃস্বরে ওয়াজ করতেন। এতে তাঁর একাগ্রতা নষ্ট হতো। বিষয়টি হজরত উমর (রা.)-এর কাছে পৌঁছলে তিনি বক্তাকে ওই স্থানে ওয়াজ করতে নিষেধ করেন। কিন্তু কিছুদিন পর তিনি ফের ওয়াজের সিলসিলা চালু করায় উমর (রা.) নিজে গিয়ে তাকে শাস্তির মুখোমুখি করেন। (আখবারুল মাদিনা : ১/১৫)এই ঘটনা প্রমাণ করে, ওয়াজ যতই দ্বিন প্রচারের মাধ্যম হোক, যদি তা অন্যের কষ্টের কারণ হয়, তাহলে তা গ্রহণযোগ্য নয়। বিশিষ্ট তাবেঈ আতা ইবনু আবি রাবাহ (রহ.) বলেন, ‘একজন আলেমের খেয়াল রাখা উচিত তার কণ্ঠস্বর যেন তার মজলিসের সীমা অতিক্রম না করে।’ (আদাবুল ইমলা ওয়াল ইসতিমলা : ৫)ফুকাহায়ে কেরাম বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি নিজের বাড়ির ছাদে উচ্চ আওয়াজে কোরআন তিলাওয়াত করে মানুষ ঘুমিয়ে থাকার মুহূর্তে, তাহলে সে গুনাহগার হবে। (ফতাওয়ায়ে শামি : ২/৩২৯, রশিদিয়া)
রাতভর ওয়াজ মাহফিলে মাইক ব্যবহার
আজ আমাদের সমাজে ওয়াজ মাহফিলের নামে গভীর রাত পর্যন্ত চার দিকে মাইক লাগিয়ে উচ্চ আওয়াজে বয়ান চালানো হয়। এতে আশপাশের অসংখ্য মানুষের ঘুম, আরাম ও দৈনন্দিন জীবন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়; শিক্ষার্থী, পরীক্ষার্থী, গবেষক, অসুস্থ ব্যক্তি, এমনকি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও কষ্ট পান। অথচ ইসলাম কাউকে কষ্ট দিয়ে দাওয়াত দেওয়ার অনুমতি দেয় না। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, ‘একদা রাসুল (সা.) মসজিদে ইতিকাফ করাকালীন সাহাবিদের উচ্চৈঃস্বরে কিরাত পাঠ করতে শুনে পর্দা উঠিয়ে বলেন : জেনে রাখ। তোমরা প্রত্যেকেই তোমাদের রবের সঙ্গে গোপন আলাপ রত আছ। অতএব, তোমরা (উচ্চস্বরে কিরাত পাঠের দ্বারা) একে অন্যকে কষ্ট দিয়ো না, তোমরা একে অন্যের চেয়ে উচ্চস্বরে কিরাত পাঠ কোরো না।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১৩৩২)এ হাদিস প্রমাণ করে, উচ্চ আওয়াজে কোরআন তিলাওয়াতও যদি অন্যের জন্য কষ্টের কারণ হয়, তবে তা নিষিদ্ধ। তাহলে ওয়াজ মাহফিলের মাইক নিয়ে আমাদের আরো কত বেশি সতর্ক হওয়া উচিত!তাই মাইক ও শব্দযন্ত্রের ব্যবহার হতে হবে শুধু প্রয়োজনের সীমার মধ্যে। যেখানে ভেতরের ব্যবস্থায়ই কাজ চলে, সেখানে বাইরের লাউডস্পিকার ব্যবহার থেকে বিরত থাকা উচিত, বিশেষত আমাদের আশপাশে বসবাসকারী বৃদ্ধ, অসুস্থ, দুর্বল, নারী ও শিশুদের অবস্থার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া ইসলামী শিষ্টাচারেরই অংশ। কারণ ইসলাম কখনোই কারো জন্য কষ্টের কারণ হওয়াকে ইবাদতের অংশ হিসেবে অনুমোদন দেয় না।দাওয়াতের প্রকৃত রূপ হলো হিকমত, শালীনতা ও রহমতের সঙ্গে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেওয়া। কণ্ঠের উচ্চতা নয়, বরং বক্তব্যের গভীরতা ও আন্তরিকতাই হৃদয় জয় করে। অতএব, আমাদের প্রত্যেকের উচিত দাওয়াত ও ওয়াজের ক্ষেত্রে এই ভারসাম্য ও সংযম বজায় রাখা।আল্লাহ তাআলা যেন আমাদের দাওয়াতকে হিকমতপূর্ণ করেন, আমাদের কণ্ঠকে রহমতের বাহক বানান এবং আমাদের আমলকে মানুষের জন্য উপকার ও শান্তির উৎস হিসেবে কবুল করেন। আমিন।