শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:২৯ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
ঢাকায় ২৪ ডিসেম্বর শুরু হচ্ছে দাওয়াতে ইসলামীর ইজতিমা। ঢাকাস্থ চাঁদপুর সমিতি: সভাপতি সালাউদ্দিন, সেক্রেটারি নূরুজ্জামান টঙ্গীতে তারেক রহমানের আগমন উপলক্ষে যুবদলের উচ্ছ্বাসময় শোভাযাত্রা নামাজে অহেতুক তাড়াহুড়োর ব্যাপারে হাদিসের সতর্কবার্তা ওয়াজ মাহফিলে মাইকের ব্যবহার ও শব্দ-সংযম : ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি নির্বাচনী ফান্ড ও ক্যাম্পেইনের সবশেষ তথ্য জানালেন আসিফ মাহমুদ পোস্টাল ভোট দিতে দেশ-বিদেশে ৪ লাখ ৮৫ হাজার নিবন্ধন ওসমান হাদির শারীরিক অবস্থার সর্বশেষ তথ্য জানাল ইনকিলাব মঞ্চ গোপালগঞ্জে ‘ঘুষের’ ১০ লাখ টাকাসহ সড়ক বিভাগের পিয়ন আটক পদত্যাগ করলেন এফবিআই-এর উপপরিচালক

ওয়াজ মাহফিলে মাইকের ব্যবহার ও শব্দ-সংযম : ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

অনলাইন ডেস্ক রিপোর্ট
  • আপডেট টাইম: বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫
ইসলাম শুধু কিছু আনুষ্ঠানিক ইবাদতের নাম নয়, বরং এটি শান্তি, ভারসাম্য ও মানবিকতাসমৃদ্ধ এক পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এই দ্বিন যেমন মানুষের ইবাদত-বন্দেগিকে সংরক্ষণ করে, তেমনি মানুষের আরাম, অধিকার, মর্যাদা ও মানসিক স্বস্তিকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ইসলামের প্রতিটি বিধানেই এই সূক্ষ্ম ভারসাম্য সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত এবং তাতে বান্দার হক সংরক্ষণের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।ওয়াজ নসিহতের মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের হৃদয়ে ঈমানের আলো জ্বালানো, তাদের অন্তরকে আল্লাহমুখী করা এবং চরিত্রকে সুন্দর ও পরিশীলিত করে তোলা।দাওয়াত কখনোই মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি করার, বিরক্তির কারণ হওয়ার কিংবা কষ্ট দেওয়ার মাধ্যম হতে পারে না, বরং তা হওয়া উচিত কোমল, শালীন ও প্রজ্ঞাপূর্ণ, যাতে মানুষের হৃদয় আকৃষ্ট হয়, তারা দূরে সরে না যায়। আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসুল (সা.)-কে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করো।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১২৫)ওয়াজ মাহফিলে মাইকের ব্যবহার এই আয়াত প্রমাণ করে, ইসলামে দাওয়াতের পদ্ধতিও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক বাস্তবতা হলো আমাদের সমাজে ওয়াজ মাহফিল ও ধর্মীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে মাইক ও লাউডস্পিকারের অপব্যবহার ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।অনেক সময় দেখা যায়, দাওয়াত ও নসিহতের নামে এমন উচ্চ আওয়াজে বক্তব্য প্রচার করা হয়, যা আশপাশের মানুষের জন্য বিরক্তি, অস্বস্তি ও কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এতে শুধু যে ইবাদতের পরিবেশ বিঘ্নিত হয় তা নয়, বরং ইসলাম যে দয়া, সহনশীলতা ও মানবিকতার শিক্ষা দেয়, তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।একজন অসুস্থ মানুষ, একান্ত বিশ্রামরত বৃদ্ধ, পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত শিক্ষার্থী কিংবা গভীর রাতে ঘুমিয়ে থাকা শিশু—এদের প্রত্যেকেরই ইসলামের দৃষ্টিতে অধিকার রয়েছে। তাদের এই স্বাভাবিক অধিকার লঙ্ঘন করে যদি দাওয়াত দেওয়া হয়, তাহলে তা ইসলামের শিক্ষা ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে যায়।কারণ ইসলাম কখনোই চায় না যে আল্লাহর নাম উচ্চারিত হবে মানুষের কষ্টের বিনিময়ে।ওয়াজ মাহফিল নিঃসন্দেহে দ্বিন প্রচার-প্রসারের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। কিন্তু এই পদ্ধতি তখনই প্রাণবন্ত ও কল্যাণকর হয়ে ওঠে, যখন সেখানে দাওয়াত দেওয়া হয় শালীনতা, প্রজ্ঞা ও সংযমের সঙ্গে। প্রযুক্তি আমাদের জন্য আল্লাহর এক বিশেষ নিয়ামত; কিন্তু সেই নিয়ামত যখন সীমা অতিক্রম করে মানুষের জন্য যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা আর নিয়ামত না থেকে পরীক্ষায় পরিণত হয়।

মাইক ব্যবহার : ইবাদত নয়, একটি উপকরণ মাত্র

প্রথমেই বুঝে নেওয়া জরুরি, মাইক বা লাউডস্পিকার ব্যবহার কোনো ইবাদত নয়, বরং এটি একটি সহায়ক উপকরণ মাত্র।শরিয়ত কোথাও খুতবা, নামাজ বা ওয়াজের জন্য মাইক ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করেনি। কাজেই এর ব্যবহার হবে প্রয়োজন অনুযায়ী, এর বেশি নয়।আজানের ক্ষেত্রে দূর পর্যন্ত আওয়াজ পৌঁছানো একটি স্বীকৃত ও প্রয়োজনীয় বিষয়। কিন্তু ওয়াজ-নসিহত, বয়ান, খুতবা, কোরআন তিলাওয়াত বা জিকিরের আওয়াজ ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায় পৌঁছে দেওয়ার কোনো ইসলামী বাধ্যবাধকতা নেই।

উচ্চ আওয়াজে ইবাদত : শরিয়তের দৃষ্টিতে আপত্তিকর

ইসলামের মৌলিক নীতি হলো, ‘কেউ যেন অপরের জন্য কষ্টের কারণ না হয়।’ ফিকহের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ আল-বাহরুর রায়েকে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে,  ‘ইমাম যদি মুসল্লিদের প্রয়োজনের সীমা অতিক্রম করে উচ্চৈঃস্বরে কিরাত করেন, তবে তিনি ভুল করেছেন।’ (১/৩৩৭)। অর্থাৎ প্রয়োজনের অতিরিক্ত উচ্চ আওয়াজ নিজেই ইসলামের দৃষ্টিতে একটি ত্রুটি।বাস্তবেও আমরা দেখি, বাইরের বড় লাউডস্পিকারের উচ্চ শব্দের কারণে আশপাশের নারী, বৃদ্ধ, রোগী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, এমনকি শিশু ও গর্ভবতী নারীরাও চরম কষ্টে পড়েন। অনেক সময় তাঁরা নিজের ঘরে শান্তিতে নামাজ পড়তে, জিকির করতে বা বিশ্রাম নিতেও পারেন না। অথচ কারো ইবাদতে বিঘ্ন সৃষ্টি করা যে গুনাহ, এ বিষয়ে শরিয়তের অবস্থান একেবারেই স্পষ্ট।

সাহাবায়ে কেরামের যুগে শব্দ-সংযমের শিক্ষা

ইতিহাস আমাদের শেখায়, শব্দ-সংযম ইসলামী সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস উমর ইবনু শায়বা (রহ.) বর্ণনা করেন, মদিনায় এক ব্যক্তি আয়েশা (রা.)-এর ঘরের নিকটে উচ্চৈঃস্বরে ওয়াজ করতেন। এতে তাঁর একাগ্রতা নষ্ট হতো। বিষয়টি হজরত উমর (রা.)-এর কাছে পৌঁছলে তিনি বক্তাকে ওই স্থানে ওয়াজ করতে নিষেধ করেন। কিন্তু কিছুদিন পর তিনি ফের ওয়াজের সিলসিলা চালু করায় উমর (রা.) নিজে গিয়ে তাকে শাস্তির মুখোমুখি করেন। (আখবারুল মাদিনা : ১/১৫)এই ঘটনা প্রমাণ করে, ওয়াজ যতই দ্বিন প্রচারের মাধ্যম হোক, যদি তা অন্যের কষ্টের কারণ হয়, তাহলে তা গ্রহণযোগ্য নয়। বিশিষ্ট তাবেঈ আতা ইবনু আবি রাবাহ (রহ.) বলেন, ‘একজন আলেমের খেয়াল রাখা উচিত তার কণ্ঠস্বর যেন তার মজলিসের সীমা অতিক্রম না করে।’ (আদাবুল ইমলা ওয়াল ইসতিমলা : ৫)ফুকাহায়ে কেরাম বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি নিজের বাড়ির ছাদে উচ্চ আওয়াজে কোরআন তিলাওয়াত করে মানুষ ঘুমিয়ে থাকার মুহূর্তে, তাহলে সে গুনাহগার হবে। (ফতাওয়ায়ে শামি : ২/৩২৯, রশিদিয়া)

রাতভর ওয়াজ মাহফিলে মাইক ব্যবহার

আজ আমাদের সমাজে ওয়াজ মাহফিলের নামে গভীর রাত পর্যন্ত চার দিকে মাইক লাগিয়ে উচ্চ আওয়াজে বয়ান চালানো হয়। এতে আশপাশের অসংখ্য মানুষের ঘুম, আরাম ও দৈনন্দিন জীবন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়; শিক্ষার্থী, পরীক্ষার্থী, গবেষক, অসুস্থ ব্যক্তি, এমনকি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও কষ্ট পান। অথচ ইসলাম কাউকে কষ্ট দিয়ে দাওয়াত দেওয়ার অনুমতি দেয় না। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, ‘একদা রাসুল (সা.) মসজিদে ইতিকাফ করাকালীন সাহাবিদের উচ্চৈঃস্বরে কিরাত পাঠ করতে শুনে পর্দা উঠিয়ে বলেন : জেনে রাখ। তোমরা প্রত্যেকেই তোমাদের রবের সঙ্গে গোপন আলাপ রত আছ। অতএব, তোমরা (উচ্চস্বরে কিরাত পাঠের দ্বারা) একে অন্যকে কষ্ট দিয়ো না, তোমরা একে অন্যের চেয়ে উচ্চস্বরে কিরাত পাঠ কোরো না।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১৩৩২)এ হাদিস প্রমাণ করে, উচ্চ আওয়াজে কোরআন তিলাওয়াতও যদি অন্যের জন্য কষ্টের কারণ হয়, তবে তা নিষিদ্ধ। তাহলে ওয়াজ মাহফিলের মাইক নিয়ে আমাদের আরো কত বেশি সতর্ক হওয়া উচিত!তাই মাইক ও শব্দযন্ত্রের ব্যবহার হতে হবে শুধু প্রয়োজনের সীমার মধ্যে। যেখানে ভেতরের ব্যবস্থায়ই কাজ চলে, সেখানে বাইরের লাউডস্পিকার ব্যবহার থেকে বিরত থাকা উচিত, বিশেষত আমাদের আশপাশে বসবাসকারী বৃদ্ধ, অসুস্থ, দুর্বল, নারী ও শিশুদের অবস্থার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া ইসলামী শিষ্টাচারেরই অংশ। কারণ ইসলাম কখনোই কারো জন্য কষ্টের কারণ হওয়াকে ইবাদতের অংশ হিসেবে অনুমোদন দেয় না।দাওয়াতের প্রকৃত রূপ হলো হিকমত, শালীনতা ও রহমতের সঙ্গে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেওয়া। কণ্ঠের উচ্চতা নয়, বরং বক্তব্যের গভীরতা ও আন্তরিকতাই হৃদয় জয় করে। অতএব, আমাদের প্রত্যেকের উচিত দাওয়াত ও ওয়াজের ক্ষেত্রে এই ভারসাম্য ও সংযম বজায় রাখা।আল্লাহ তাআলা যেন আমাদের দাওয়াতকে হিকমতপূর্ণ করেন, আমাদের কণ্ঠকে রহমতের বাহক বানান এবং আমাদের আমলকে মানুষের জন্য উপকার ও শান্তির উৎস হিসেবে কবুল করেন। আমিন।

নিউজটি শেয়ার করুন..

  • Print
  • উত্তরা নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন:
এ জাতীয় আরো খবর..
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৩-২০২৫ | Technical Support: Uttara News Team
themesba-lates1749691102