মানুষ এই দুনিয়ায় যত কিছু দেখে, শোনে, অনুভব করে; তার সবই সীমিত। আমাদের জ্ঞান, কল্পনা ও অভিজ্ঞতার দেয়াল কখনোই অতিক্রম করতে পারে না আল্লাহর অদেখা জগতের পর্দা। তবু মানুষ চিরদিন এক অপূর্ব আশার প্রতীক্ষায় থাকে—এক এমন জগৎ, যেখানে নেই কষ্ট, নেই হারানোর ভয়; আছে চিরস্থায়ী প্রশান্তি ও চোখের শীতলতা। ঠিক সেই অনন্ত পুরস্কারের কথাই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই হাদিসে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন-
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ اللهُ أَعْدَدْتُ لِعِبَادِي الصَّالِحِيْنَ مَا لَا عَيْنٌ رَأَتْ وَلَا أُذُنٌ سَمِعَتْ وَلَا خَطَرَ عَلَى قَلْبِ بَشَرٍ فَاقْرَءُوْا إِنْ شِئْتُمْ فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَا أُخْفِيَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ
আবু হুরাইরাহ্ (রা.) হতে বর্ণিত।
তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ বলেছেন, আমি আমার নেককার বান্দাদের জন্য এমন জিনিস তৈরি করে রেখেছি, যা কোন চক্ষু দেখেনি, কোন কান শুনেনি এবং যার সম্পর্কে কোন মানুষের মনে ধারণাও জন্মেনি। তোমরা চাইলে এ আয়াতটি পাঠ করতে পার, ‘‘কেউ জানে না, তাদের জন্য তাদের চোখ শীতলকারী কী জিনিস লুকানো আছে’’- সুরা আসসিজদাঃ, আয়াত: ১৩। (বুখারি, হাদিস: ৩২৪৪)
হাদিসের ব্যাখ্যা
এই হাদিস আল্লাহর রহমত ও জান্নাতের অনুপম সৌন্দর্যের এক আভাস বহন করে। এখানে তিনটি ইন্দ্রিয়গত সীমা নির্দেশ করা হয়েছে— (১) কোনো চোখ দেখেনি, (২) কোনো কান শোনেনি, (৩) কোনো মন কল্পনাও করতে পারেনি।
অর্থাৎ, জান্নাতের নেয়ামত এমন পরিপূর্ণ ও সূক্ষ্ম যে, মানব অভিজ্ঞতার কোনো ভাষায় তাকে বর্ণনা করা যায় না।
ইমাম নববী (রহ.) বলেন— ‘এতে জান্নাতের অসীম মহিমা ও দুনিয়াবি সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে তার তুলনার অযৌক্তিকতা ইঙ্গিত করা হয়েছে।’ (শরহ মুসলিম, নববী)
‘চোখের শীতলতা’—এর অর্থ কী?
আরবি শব্দ “قُرَّةُ أَعْيُنٍ” অর্থ ‘চোখের শীতলতা’। প্রাচীন আরবিতে এটি ছিল আনন্দ ও পরম প্রশান্তির রূপক।
অর্থাৎ, এমন আনন্দ যা চোখে অশ্রু আনতে পারে না, বরং মনকে শীতল করে। আল্লাহর এই প্রতিশ্রুত পুরস্কার এমন এক পরিতৃপ্তি দেবে, যা মানব হৃদয়ের সকল আকাঙ্ক্ষাকে ছাড়িয়ে যাবে।
কেন শুধুই নেককারদের জন্য?
আল্লাহ বলেন— “আমি আমার নেককার বান্দাদের জন্য (أَعْدَدْتُ لِعِبَادِيَ الصَّالِحِينَ) প্রস্তুত করেছি।” এটি ইঙ্গিত করে যে, জান্নাত অর্জনের পথ শুধু ঈমান নয়, বরং সৎকর্মও আবশ্যক। যেমন কুরআনে এসেছে—
وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُو۟لَـٰٓئِكَ أَصْحَـٰبُ ٱلْجَنَّةِ“যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, তারাই জান্নাতের অধিবাসী।” (সুরা আল-বাকারা, আয়াত : ৮২)
জান্নাত—মানব কল্পনার সীমা পেরিয়েহাদিসের অর্থ এই নয় যে, জান্নাতে চোখ বা কান থাকবে না; বরং জান্নাতের দৃশ্য, শব্দ ও অনুভূতি এতই নতুন ও অপরূপ হবে যে, তার কোনো তুলনা পৃথিবীর জগতে নেই। যেমন রাসুলুল্লাহ (সা.) অন্য এক হাদিসে বলেন— “জান্নাতে একটি চাবুক পরিমাণ জায়গাও দুনিয়া ও তার সমস্ত কিছুর চেয়ে উত্তম।” (বুখারি, হাদিস: ৬৫৮৮) অর্থাৎ, জান্নাতের ক্ষুদ্রতম অংশও দুনিয়ার সমগ্র রাজত্ব ও বিলাসিতার চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
হাদিস থেকে আত্মিক শিক্ষা১. আল্লাহর প্রতিশ্রুতি চিরসত্য। তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাদের জন্য যা রেখেছেন তা মানুষের চিন্তার বাইরে।
২. দুনিয়ার কষ্ট ধৈর্যের পরীক্ষা মাত্র। এই ধৈর্যই জান্নাতের চাবিকাঠি।
৩. আল্লাহর পথে নেক আমলই জান্নাতের যোগ্যতা তৈরি করে।
৪. জান্নাতের ধারণা মানুষের অন্তরে আশা জাগিয়ে তোলে, যা তাকে পাপ থেকে বিরত রাখে এবং ইবাদতের প্রতি অনুপ্রাণিত করে।এই হাদিস আমাদেরকে শেখায় যে, দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী সুখের মোহে না পড়ে, চিরস্থায়ী জান্নাতের প্রস্তুতি নিতে। কারণ যে জান্নাতের নেয়ামত কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান শুনেনি, এবং কোনো হৃদয় কল্পনাও করতে পারেনি—তার বিনিময়ে সামান্য দুনিয়াবি ত্যাগও বড় মূল্যবান নয়।জান্নাত শুধু এক পুরস্কার নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতিফলন। তিনি নিজে যখন বলেন— “আমি প্রস্তুত করেছি…” — তখন তাতে এমন ভালোবাসা ও করুণা নিহিত, যা তাঁর প্রিয় বান্দাদের জন্য পরম সুখের চিরন্তন নিশ্চয়তা।
এ জাতীয় আরো খবর..