বুধবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:১৯ অপরাহ্ন

‘ভাইব্রেন্ট’ বিচার বিভাগ পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ

জাতীয় ডেস্ক
  • আপডেট টাইম: বুধবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২৫
সংগৃহীত ছবি | উত্তরা নিউজ

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর স্বাধীন ও শক্তিশালী বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার দ্বার খুলে যায়। কারণ, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ছিল মূলত ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার যৌথ আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। একটি সমাজে স্বাধীন বিচার বিভাগ থাকা যে কতটা জরুরি, তা দেশের সচেতন মানুষকে উপলব্ধি করতে শেখায় এই গণ-অভ্যুত্থান। এরপরই দেশের বিচার বিভাগ সংস্কারের জোরালো দাবি জনমানসে উত্থাপিত হয়।

শেখ হাসিনার পতনের ধারাবাহিকতায় গত বছরের ১০ আগস্ট প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। বিশ্বখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াডাম কলেজ থেকে ‘আজীবন সম্মাননা ফেলোশিপ’ পাওয়া এই বিচারপতি এমন এক কঠিন সময়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, যখন বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা ছিল পর্বতসম এবং বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন ছিল সময়ের অনিবার্য দাবি। এমন প্রেক্ষাপটে জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে ধারণ করে ২০২৪ সালের ২১ ডিসেম্বর স্বাধীন ও শক্তিশালী বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় ঐতিহাসিক রোডম্যাপ ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি। এই রোডম্যাপে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা, আইন মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্ব বিলোপ, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রবর্তন, কলেজিয়াম পদ্ধতিতে বিচারপতি নিয়োগসহ একাধিক সংস্কারের সুপারিশ করা হয়। পাশাপাশি ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার আপিল বিভাগের সাবেক একজন বিচারপতিকে প্রধান করে ‘বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন’ গঠন করে। এই কমিশনও বিচার বিভাগ সংস্কারে অনেকগুলো সুপারিশ করে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধান বিচারপতির ঘোষিত রোডম্যাপ ও সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিচার বিভাগ সংস্কারে রোডম্যাপ বাস্তবায়নে প্রধান বিচারপতি দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটে গেছেন। তার নিরলস প্রচেষ্টার কারণে অনেকগুলো পদক্ষেপ ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট বিচার বিভাগ স্বাধীনতার পথে যাত্রা শুরু করেছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়’ প্রতিষ্ঠাসহ কয়েকটি বড়ো উদ্যোগ বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিচার বিভাগের পুরোপুরি স্বাধীনতার পথে কিছু চ্যালেঞ্জ বা বাধা রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ বা বাধা উতরে বাংলাদেশে স্বাধীন, শক্তিশালী, নতুন ধারার ‘ভাইব্রেন্ট’ বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা পাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

dhakapost
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সিদ্দিকী

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সিদ্দিকী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগ সংস্কারে যে রোডম্যাপ দিয়েছিলেন, তা অধিকাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। আমরা দুটি বিধিমালা পেয়েছি। অধস্তন আদালতের জন্য সার্ভিস রুলস বিধিমালা পেয়েছি। ২৩২টি পদ সৃজন করা হয়েছে। এটি বিচার বিভাগ সংস্কারে বড় অগ্রগতি। সিভিল ও ক্রিমিনাল কোর্ট আলাদা করা হয়েছে। আমরা আলাদা বাণিজ্যিক আদালত পেতে যাচ্ছি। অধস্তন আদালতের পদ সৃজনের ক্ষমতা স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রগতি বলে মনে করি। আমি মনে করি, একটি জনবান্ধব ও স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নপূরণ হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।’

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট তানিম হোসাইন শাওন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট ও সংস্কার কমিশনের খসড়া সমন্বয় করে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন প্রণীত হয়েছে। এই আইনের অধীনে ইতোমধ্যে উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ শুরু হয়েছে। এটা একটা বড় সফলতা। এছাড়া, সংস্কার কমিশন যেসব সংস্কারের সুপারিশ করেছিল, তার কিছু কিছু বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছে। যেমন- সুপ্রিম কোর্ট সেক্রেটারিয়েট আইন। আমরা আশা করি এটাও এই সরকার শিগগিরই বাস্তবায়ন করবে। আমরা ফৌজদারি কার্যবিধি, দেওয়ানি কার্যবিধিতে কিছু সংশোধন আনতে বলেছিলাম। সেগুলোসহ অন্যান্য সংশোধন এরই মধ্যে আনা হয়েছে। আমরা লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে মেডিয়েশন-কে প্রমোট করার কথা বলেছিলাম। সেটিও বাস্তবায়িত হয়েছে, ১২ জেলায় কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া, কিছু সুপারিশ এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন পর্যায়ে যায়নি। যেমন- অ্যাটর্নি সার্ভিস আইন। এর খসড়া হয়েছে। খসড়া নিয়ে এক দফা মতবিনিময় হয়েছে। আশা করছি, দ্রুত এই আইন নিয়েও কাজ হবে। এসব বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নপূরণ হবে।’

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে যত পদক্ষেপ— 

সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার বিচার বিভাগকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সংসদে পাস করেছিল। হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ এই সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করলেও সরকারের অসহযোগিতার কারণে এই মামলা দীর্ঘদিন ঝুলে ছিল। ফলে বিচারপতি অপসারণের কোনো ফোরাম ছিল না।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি করেন আপিল বিভাগ এবং এর মাধ্যমে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবিত হয়। আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীকে নিয়ে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে তিন সদস্যের কাউন্সিল গঠিত হয়।

নিয়ম অনুযায়ী, যদি কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে, তবে সেই অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ দুজন বিচারপতি নিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়। যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ওই বিচারপতিকে অপসারণ বা অন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠায়। রাষ্ট্রপতি পরবর্তীতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশ অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ইতোমধ্যে এই কাউন্সিলের সিদ্ধান্তে একাধিক বিচারপতি অপসারিত হয়েছেন।

dhakapost
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল

সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল গঠন

প্রধান বিচারপতির রোডম্যাপ অনুযায়ী সরকার সুপ্রিম কোর্টের ‘বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করে। গত ২১ জানুয়ারি জারি করা এ অধ্যাদেশ অনুযায়ী, এখন থেকে স্বতন্ত্র কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারক নিয়োগ দেওয়া হবে। উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগে দলীয়করণমুক্ত ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

অধ্যাদেশে সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে এ কাউন্সিলে থাকবেন— আপিল বিভাগের দুজন বিচারক (একজন অবসরপ্রাপ্ত ও একজন কর্মরত), হাইকোর্টের দুজন বিচারক, অ্যাটর্নি জেনারেল, কাউন্সিলের চেয়ারম্যান (প্রধান বিচারপতি) মনোনীত একজন আইন বিশেষজ্ঞ বা আইনের অধ্যাপক।

আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানান, এই কাউন্সিল নিজ উদ্যোগে প্রার্থী তালিকা তৈরি করবে। পাশাপাশি আইনজীবীসহ যে কেউ নিজের নাম প্রস্তাব করতে বা আবেদন করতে পারবেন। প্রাথমিক যাচাই-বাছাই শেষে কাউন্সিল সাক্ষাৎকার গ্রহণ করবে এবং যোগ্য ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেবে।

ইতোমধ্যে প্রধান বিচারপতি বিচারক নিয়োগ কাউন্সিল গঠন করেছেন। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে আপিল বিভাগে বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুবকে নিয়োগ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। গত ২৫ আগস্ট সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিলের সুপারিশের ভিত্তিতে হাইকোর্টে ২৫ জন বিচারপতি নিয়োগ দেয় সরকার। এই নিয়োগকে ‘বিতর্কমুক্ত’ বলছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।

দ্বারপ্রান্তে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠন

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বিচারপতির রোডম্যাপ ও সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বিচার বিভাগ সংস্কারে নেওয়া সবচেয়ে সাহসী পদক্ষেপ হলো- পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সংস্কার কার্যক্রমকে পূর্ণতা দিতে যাচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য অধ্যাদেশ জারির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শক্রমে আইন মন্ত্রণালয় থেকে ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য অধ্যাদেশের খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, ‘বিচার বিভাগের আলাদা সচিবালয় প্রতিষ্ঠার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।’

এ বিষয়ে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় করাটা বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের অন্যতম একটি সুপারিশ ছিল। আমাদের প্রধান বিচারপতির সংস্কার ভাবনার মধ্যেও এটি রয়েছে। এ বিষয় নিয়ে আমরা অনেক কাজ করেছি। আমার ধারণা, এ সরকারের আমলেই সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় করতে পারব।’ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পৃথক সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা হলে তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য মাইলফলক হিসেবে ইতিহাসে স্থান পাবে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্রের মৌলিক নীতিগুলোর একটি। তাই আলাদা সচিবালয় গঠিত হলে নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, শৃঙ্খলা ও ছুটিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদ্যমান দ্বৈত নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটবে এবং বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে।

dhakapost
সংস্কার কমিশনের সদস্য ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তানিম হোসাইন শাওন

বিচারকদের বদলি-পদায়নের খসড়া নীতিমালা

অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি-পদোন্নতির কোনো নীতিমালা ছিল না। প্রধান বিচারপতির রোডম্যাপ অনুসারে, গত বছরের ৩ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও পদায়ন নীতিমালার খসড়া প্রকাশ করে। সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বিচারকদের বদলি ও পদায়নে অভিন্নতা বজায় রাখা এবং দক্ষ বিচার প্রশাসন গঠন করার উদ্দেশ্যে এই নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের দিকনির্দেশনায় হাইকোর্ট বিভাগ এই খসড়া প্রণয়ন করে।

খসড়া অনুযায়ী, বিচারককে কোনো কর্মস্থলে (আদালত/ট্রাইব্যুনাল) বদলি করা যাবে না, যেখানে তার স্বামী/স্ত্রী, বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি, ভাই-বোন, পিতামহ বা মাতামহ আইন পেশায় নিযুক্ত রয়েছেন। সহকারী জজ হিসেবে যোগদান করার আগে কোনো আইনজীবী সমিতিতে দুই বছর আইন পেশা পরিচালনা করলে, চাকরিতে যোগদানের তারিখ হতে পরবর্তী ১০ বছর তাকে উক্ত জেলায় পদায়ন করা যাবে না।

কোনো বিচারকের যদি কৃষি বা অকৃষি ভূমির মালিকানা থাকে, তবে তাকে সেই জেলায় পদায়ন করা যাবে না। এছাড়া, বিচারকদের কর্মস্থলে তিন বছরের বেশি দায়িত্ব পালনের বিধান রাখা হয়েছে। তবে, বিশেষ দায়িত্বে নিয়োজিত থাকলে বা বদলির কারণে বিচার প্রশাসনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে পারে— এমন ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির অনুমতিতে আরও এক বছর একই কর্মস্থলে দায়িত্ব পালনের সুযোগ থাকবে।

চৌকি আদালতে কর্মরত বিচারকের পদায়নের মেয়াদকাল হবে সর্বোচ্চ এক বছর। এর বাইরেও খসড়ায় আরও গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুতই এই নীতিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ করবে সরকার।

অধস্তন আদালতের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিম কোর্টের হাতে

গত ২ সেপ্টেম্বর অধস্তন আদালতের দায়িত্বপালনরত বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, দান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব পুরোপুরি সুপ্রিম কোর্টের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে রায় দেন হাইকোর্ট। বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান সম্বলিত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের সংশোধনী অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করে এবং বাহাত্তরের সংবিধানের মূল ১১৬ অনুচ্ছেদ বহাল করে বিচারপতি আহমেদ সোহেল ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।

রায়ে সুপ্রিম কোর্টের অধীন সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষের পাঠানো প্রস্তাবনা অনুসারে তিন মাসের মধ্যে একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি রায়ে বিচারকদের জন্য ২০১৭ সালে তৈরি করা শৃঙ্খলাবিধি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হয়েছে। এ রায়ের ফলে এখন থেকে বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ, বদলি ও শৃঙ্খলা বিধানের জন্য রাষ্ট্রপতিকে সুপ্রিম কোর্টে আর ধরনা দিতে হবে না। পাশাপাশি স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় যে বাধা ছিল সেটিও দূর হয়ে যায়। এখন থেকে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নামে বিচারকদের বদলি ও শৃঙ্খলা বিধানের ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে আর কোনো কিছুই থাকল না।

পৃথক দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত

প্রধান বিচারপতির নির্দেশে ২০২৫ সালের ২১ এপ্রিল আইন মন্ত্রণালয়ে একটি পত্র পাঠিয়ে ফৌজদারি ও দেওয়ানি বিচারিক কার্যক্রম আলাদা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সংশ্লিষ্ট বিচার বিভাগের কাঠামোতে পরিবর্তন এনে পর্যাপ্ত সংখ্যক পদ সৃষ্টি করার অনুরোধ জানানো হয়।

অবশেষে গত ১৮ সেপ্টেম্বর দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক করা হয়। ফলে মামলা পরিচালনার সময় বাঁচবে এবং দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার নিষ্পত্তি বহুলাংশে বাড়বে। আইন মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, যুগান্তকারী এই সিদ্ধান্তের ফলে জেলা পর্যায়ে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত সম্পূর্ণভাবে পৃথক হয়ে যাচ্ছে। এতে করে দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় আদালতেই মামলা নিষ্পত্তির পরিমাণ ও গতি আগের চেয়ে বহুলাংশে বাড়তে পারে। ফলে বিদ্যমান মামলাজট উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

dhakapost
অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির

২৩২ বিচারিক পদ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত

বিচার বিভাগ সংস্কারের অংশ হিসেবে দেশের বিভিন্ন আদালতে ২৩২টি বিচারকের পদ সৃষ্টি করতে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গত ৩ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে জানানো হয়, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের আদেশক্রমে ও বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা, ২০২৫–এর বিধি ৫ অনুসারে বিচারিক পদ সৃষ্টির বিষয়ে গঠিত কমিটি সুপ্রিম কোর্টে সভা করে। সভায় সিদ্ধান্ত হয়— শিশু ধর্ষণ অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের জন্য জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদায় ৬৪ জেলায় ৬৪টি ও মহানগর এলাকায় আরও আটটিসহ মোট ৭২টি পদ সৃষ্টি করা হবে।

এছাড়া পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান ছাড়া বাকি ৬১টি জেলায় জেলা জজ পদমর্যাদার পারিবারিক আপিল আদালতের বিচারক নিয়োগের জন্য ৬১টি পদ ও ঢাকা জেলায় মামলার সংখ্যা অনুপাতে অতিরিক্ত আরও চারটিসহ মোট ৬৫টি পদ সৃষ্টি করা হবে। একইসঙ্গে দেশে বিদ্যমান ৫৪টি ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনালের জন্য জেলা জজ পদমর্যাদার ৫৪টি ও ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের জন্য আগে সৃজিত যুগ্ম জেলা জজ পদমর্যাদার ১৩টি পদ বাদ দিয়ে অবশিষ্ট ৪১টি বিচারকের পদ সৃষ্টি করা হবে। সবমিলিয়ে ২৩২টি নতুন বিচারিক পদ সৃজনে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়। সভায় আরও সিদ্ধান্ত হয়— নতুন পদের বিপরীতে সহায়ক জনবল নিয়োগ, অফিস সরঞ্জাম নির্ধারণ এবং এ–সংক্রান্ত প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ বিভাগে পাঠানোসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সম্পাদনের জন্য আইন ও বিচার বিভাগ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে। প্রধান বিচারপতির অনুমোদনক্রমে এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

স্বচ্ছতা আনতে ১২ দফা নির্দেশনা

প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এবং দুর্নীতিমুক্ত সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সেবার মানোন্নয়নে ১২ দফা নির্দেশনা জারি করেন। এই নির্দেশনাগুলোর বাস্তবায়ন তদারক করতে সুপ্রিম কোর্টে প্রতি মাসে নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যেখানে সভাপতিত্ব করছেন প্রধান বিচারপতি নিজে। জেলা পর্যায়ের আদালতেও এ ধরনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ফলে বিচার বিভাগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি অনেকাংশে নিশ্চিত হয়েছে।

পেপারলেস হাইকোর্ট বেঞ্চ

প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে বিচার সেবা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ২০২৫ সালের ২ জানুয়ারি বিচারপতি আহমেদ সোহেলের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের কোম্পানি বেঞ্চে সম্পূর্ণ কাগজবিহীন (পেপারলেস) বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। এ উদ্দেশ্যে সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে। পরে ২০ জুলাই আরেকটি কোম্পানি বেঞ্চেও কাগজবিহীন বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। প্রধান বিচারপতির পরিকল্পনা অনুযায়ী, ভবিষ্যতে অন্যান্য বেঞ্চেও এই পদ্ধতি চালু করা হবে।

সুপ্রিম কোর্টসহ সারা দেশের আদালতে হেল্পলাইন চালু

২০২৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টে সেবাগ্রহীতাদের জন্য একটি হেল্পলাইন চালু করা হয়। পরে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় হেল্পলাইন চালু করা হয়। এছাড়া, সব নাগরিকের জন্য বিচার সেবা নিশ্চিতে ২০২৫ সালের ১৪ মে দেশের ৬৪ জেলা ও আট মেট্রোপলিটন এলাকায় হেল্পলাইন চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রতিটি জেলায় তিন সদস্যের কমিটি গঠন এবং জেলা ও দায়রা জজকে সিমসহ মোবাইল ফোন সরবরাহ করা হয়েছে।

বিদেশি কূটনীতিকদের আস্থার প্রতিষ্ঠানে পরিণত

ব্রিটিশ স্টাইলে অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলা প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে বাংলাদেশের বিচার বিভাগকে আস্থার সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন। ইউএনডিপিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান, মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় করেছেন। বিদেশি কূটনীতিকরা প্রধান বিচারপতি ঘোষিত রোডম্যাপ ও সংস্কার কার্যক্রমের প্রশংসা করেছেন এবং বাংলাদেশে স্বাধীন ও শক্তিশালী বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।

স্বাধীন বিচার বিভাগের পথে বাংলাদেশ: আইন বিশেষজ্ঞরা কে কী বলছেন

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ যখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন তখন তিনি বিচার বিভাগ সংস্কারের জন্য রোডম্যাপ ঘোষণা করেছিলেন। স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় তার অনেকগুলো উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য মূল যে বিষয়, সুপ্রিম কোর্টকে মন্ত্রণালয় থেকে মুক্ত করা; এটা করার জন্য যে বাধাটা ছিল সেটা হলো সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ। সেটা স্বাধীন বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে বাধা ছিল। এরই মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগ সংবিধানের সেই বিধানটি বাতিল করেছেন। সুতরাং সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আর কোনো বাধা নেই।’

‘দীর্ঘদিন ধরে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা আমরা মুখে বললেও প্রকৃতপক্ষে নির্বাহী বিভাগের যারা দায়িত্বে থাকেন, যারা এ কাজটি করবেন তারা সবসময় সহযোগিতা করেন না। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছিল, প্রধান বিচারপতি যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন সেই উদ্যোগকে অন্তর্বর্তী সরকার সমর্থন করবেন। কিন্তু আমার কাছে কেন যেন মনে হচ্ছে, এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয় থেকে মুক্ত হলেও সুপ্রিম কোর্টের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় করা, সেটা হয়ে ওঠেনি। এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় বাধা মনে হয়। নির্বাহী বিভাগের যতটা সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল, ততটা সহযোগিতা হয়তো পাওয়া যায়নি। আমি মনে করি, এখানে নির্বাহী বিভাগের সদিচ্ছা প্রয়োজন। আমরা দেখতে চাই, সুপ্রিম কোর্ট সম্পূর্ণ স্বাধীন তাদের কার্যক্রমের ক্ষেত্রে। আমি প্রত্যাশা করব, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সুপ্রিম কোর্টের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় স্থাপনসহ বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ এ বিষয়ে অত্যন্ত সক্রিয়।’

dhakapost
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা 

সংস্কার কমিশনের সদস্য ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তানিম হোসাইন শাওন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিচারপতি নিয়োগে যে আইন হয়েছে, এর মাধ্যমে দলীয়করণ অনেক কমে যাবে। তবে, পুরোপুরি চলে যাবে না। পৃথিবীর কোথাও একেবারে শূন্য রাজনৈতিক বিবেচনার কোনো উদাহরণ নেই। সব জায়গায় কিছু বিবেচনা থাকে। কিন্তু সেটাকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনা সম্ভব। যেমন- আমরা আবেদনকারীদের থেকে যতগুলো তথ্য চেয়েছি, যত দলিল চেয়েছি, সেগুলো যারা দিতে পারবেন, যে ইন্টারভিউ প্রসেস আছে…, যদি তারা অংশগ্রহণ করতে পারেন…; রাজনৈতিক পরিচয় মানেই যে তিনি বিচারক হওয়ার অযোগ্য, তা নয়। যোগ্যতা থাকতেই হবে। তারা যদি তথ্যগুলো জমা দেন, তাহলে সেগুলো যাচাই করে দেখা সম্ভব। আইনের ভিত্তিতে যদি সংক্ষিপ্ত তালিকা হয়, একটা ইন্টারভিউ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যদি তারা নিয়োগপ্রাপ্ত হন…; প্রধান বিচারপতি নিয়োগে আমাদের সুপারিশ হচ্ছে যিনি আপিল বিভাগের সবচেয়ে বেশি সিনিয়র, তিনিই হবেন প্রধান বিচারপতি। এসব সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার পথ আরও সুগম হবে।’

অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ যেন প্রতিষ্ঠা হয়, আমাদের জায়গা থেকেও সেই চেষ্টা চলছে। আমি মনে করি, সেপারেট জুডিশিয়াল সেক্রেটারিয়েট প্রতিষ্ঠা এবং ১১৬ অনুচ্ছেদের ওপর যে রায় হাইকোর্ট দিয়েছেন, এটির যদি বাস্তবায়ন হয় তাহলে ষোলকলা পূর্ণ হবে। অধস্তন আদালতের ওপর সুপ্রিম কোর্টের যে নিয়ন্ত্রণ সেটি প্রতিষ্ঠা পাবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি একটি নতুন গতিধারা ফিরে পাবে। কমার্শিয়াল আদালত প্রতিষ্ঠা করার যে চেষ্টা চলছে, এটা ভেরি ইনোভেটিভ আইডিয়া। এটা হতে হবে।’

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা : আরও যেসব উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন

বিচার বিভাগের পুরোপুরি স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে এবং একটি শক্তিশালী বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার জন্য আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সিদ্দিকী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পৃথক সচিবালয় এখনও পাইনি। এটি হলে বিচার বিভাগের কাজে গতি আসবে। বিচার বিভাগের চাহিদাগুলো সরকারকে আরও দৃঢ়ভাবে জানাতে পারব। এখন তো আমরা দ্বৈত শাসনের মধ্যে আছি। আশা করি, দ্রুতই এর অবসান ঘটবে। এছাড়া, আদালতে সহায়ক স্টাফ ও অবকাঠামোগত কিছু অসুবিধা রয়েছে। এগুলোর সমাধান হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পূর্ণতা পাবে।’

অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘ই-জুডিশিয়ারি সিস্টেম এখানে প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। যদি বাংলাদেশের বিচার বিভাগে আরও অধিক সংখ্যক বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া যেত, একইসঙ্গে আপিল বিভাগকে বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিকোণ থেকে আলাদা করা যেত; অর্থাৎ ক্রিমিনাল হবে, সিভিল হবে এক বেঞ্চে; রিট ও কোম্পানি হবে আরেক বেঞ্চে। এসব প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে পারলে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য বিচার বিভাগ তৈরি করা যেত। সর্বোপরি আরও একটি জিনিস বাকি রয়েছে, বিচার বিভাগের যে প্রশাসনিক দক্ষতা, এটাকে যদি ই-জুডিশিয়ারি মেকানিজমের মধ্যে আনা যায়, তাহলে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ আরও ভাইব্রেন্ট হবে।’

সংস্কার কমিশনের সদস্য ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তানিম হোসাইন শাওন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আরও কিছু সংস্কার বাস্তবায়নের উদ্যোগ সুপ্রিম কোর্ট নিজেও নিতে পারত। যেমন- সুপ্রিম কোর্টের মামলা ব্যবস্থাপনা। এ বিষয়ে আমাদের সুনির্দিষ্ট পরামর্শ ছিল, কীভাবে আদালতের সময়টা বেশি কাজে লাগানো যায়। আমরা বলেছিলাম, প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকাজের সময় বৃদ্ধি করা। যেমন- এখন মেনশন আওয়ারে অনেক সময় চলে যায়। সেটার জন্য অনলাইন মেনশন স্লিপ চালুর কথা আমরা বলেছিলাম। এছাড়া আমরা বলেছিলাম, আদালত যখনই যে আদেশ দেবেন তার রেজাল্ট যেন সঙ্গে সঙ্গে কজলিস্টে চলে আসে। এটা আপিল বিভাগে প্রচলিত আছে। কিন্তু হাইকোর্টের সব বেঞ্চে এখনও এটা করা হয়নি। সবগুলো জাজমেন্ট যেন অনলাইনে চলে আসে, তাহলে বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা আরও নিশ্চিত হবে।’

স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা : বাস্তবায়নে যত চ্যালেঞ্জ

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাধীন ও শক্তিশালী বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার জন্য যে পদপেক্ষপগুলো নেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের পথে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, আমরা যে সংস্কারগুলো করেছি, এখনই এগুলোর সুফল পাব না। সময় লাগবে। আমরা আইন করে যাব, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারও করে যাচ্ছি, কিন্তু যদি পরবর্তীতে নির্বাচিত সরকার এসে এই সংস্কার কার্যক্রম আন্তরিকভাবে এগিয়ে নিয়ে না যায়, তাহলে আমরা কাঙ্ক্ষিত সুফল পাব না।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল মনে করেন, বিচার বিভাগের পুরোপুরি স্বাধীনতা নিশ্চিতের পথে বড় বাধা নির্বাহী বিভাগের অসহযোগিতা। তিনি বলেন, নির্বাহী বিভাগের অসহযোগিতার কারণে এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয় মুক্ত করে সুপ্রিম কোর্টের স্বতন্ত্র সচিবালয় হয়ে ওঠেনি। নির্বাহী বিভাগের যে পরিমাণ সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল সে পরিমাণ সহযোগিতা হয়তো পাওয়া যাইনি। আমি মনে করি, এক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের সদিচ্ছা প্রয়োজন। আমরা দেখতে চাই, সুপ্রিম কোর্ট সম্পূর্ণ স্বাধীন তাদের কার্যক্রমের ক্ষেত্রে। আমি প্রত্যাশা করব, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সুপ্রিম কোর্টে স্বতন্ত্র সচিবালয় স্থাপনসহ বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে।

সংস্কার কমিশনের সদস্য অ্যাডভোকেট তানিম হোসাইন শাওন বলেন, ‘সময়টা একটা চ্যালেঞ্জ। যেহেতু নির্বাচন ফেব্রুয়ারি মাসে হবে, সেক্ষেত্রে দেখা যাবে যে নভেম্বরের পর আর আইন প্রণয়নের সুযোগ নেই। এটা একটা বিশাল সীমাবদ্ধতা। আরেকটা চ্যালেঞ্জ হলো- সমন্বয়ের অভাব। আমাদের কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে যদি সুপ্রিম কোর্ট আমাদের সঙ্গে বসতেন, তাহলে সংস্কার উদ্যোগগুলোর বাস্তবায়ন সহজ ও দ্রুত হতো।’

অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘বড়ো চ্যালেঞ্জ হলো, স্বাধীনভাবে যারা ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চান, এখনও আমরা তাদের ওপর আস্থা রাখতে চাই না। মনে করি, আমার বিপক্ষে চলে গেল। আমার বিপক্ষে রায় দিয়ে দেবে কি না, আমার লোক কি না, আমাদের লোক কি না— এই সাইকোলজিক্যাল চ্যালেঞ্জ আছে। অর্থাৎ, সবাই চায় নিজের মতাদর্শের লোকেরা যেন বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। এই চাওয়াটাই একটা ফল্ট চাওয়া। আমরা চাইব যোগ্য লোক, আমরা চাইব সৎ লোক। আমরা চাইব অভিজ্ঞ লোক। যাদের বিচার বিভাগ ম্যানেজ করার মতো ক্যাপাসিটি আছে, এই ধরনের লোক। যার পক্ষেই যাক, সেটা বড় বিষয় না। দেখতে হবে সেটা দেশের পক্ষে গেছে কি না, মানুষের পক্ষে আছে কি না। এই মানসিকতার পরিবর্তন একটা চ্যালেঞ্জ। আগামী নির্বাচনে যে দলই সরকার গঠন করুক, আমি মনে করি সবাইকে এসব বিষয় প্রাধান্য দেওয়া উচিত। মতাদর্শ যেটাই হোক, বিচারক যেন শপথ অনুযায়ী কাজ করতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাংলাদেশের বিচার বিভাগে যে সংস্কার হয়েছে, আমি মনে করি সেগুলো বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় বাধা বা চ্যালেঞ্জ হচ্ছে— রাজনৈতিক প্রভাব বা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। বিচারকরা যখন কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন বা তারা একই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন, তখন সেটি কিন্তু বিচার ব্যবস্থা এবং সাধারণ নাগরিক যারা রয়েছেন, তাদের স্বচ্ছ বিচারপ্রাপ্তিতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। একটি জিনিস লক্ষ করবেন, দেশে যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে, কোনো রাজনৈতিক সরকার কখনওই চায়নি যে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করুক। সব সরকার তাদের মনমতো বিচারক চেয়েছেন এবং তাদের পছন্দের মতো বিচারক নিয়োগ দিয়েছেন। রাজনীতিবিদরা যখন বিচার বিভাগকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করতে চান এবং সেই হস্তক্ষেপ যদি থাকে, তাহলে সেটি স্বাধীনভাবে এবং নিরপেক্ষভাবে কাজ করার জন্য বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে বড় বাধা।’

নিউজটি শেয়ার করুন..

  • Print
  • উত্তরা নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন:
এ জাতীয় আরো খবর..
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৩-২০২৫ | Technical Support: Uttara News Team
themesba-lates1749691102