চট্টগ্রাম বন্দরের চালু থাকা নিউমুরিং টার্মিনালসহ ভবিষ্যতে নতুন তিনটি টার্মিনাল নির্মাণ ও সেগুলোর পরিচালনা বিদেশি কোম্পানি হাতে চলে যাচ্ছে। এমন তথ্য জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক। বিদেশি অপারেটর নিয়োগের প্রক্রিয়া এবং একই সঙ্গে ট্যারিফ বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে যখন নানা আলোচনা চলছে, তখন এমন তথ্য জানালেন তিনি।
বিবিসি বাংলাকে ওমর ফারুক জানান, এপিএম আলাদা একটা টার্মিনাল করছে লালদিয়ার চর। তাদের আমরা প্রায় ৩৫ একরের মতো জায়গা দিয়েছি। সেটা তারা বিল্ড, অপারেট অ্যান্ড ট্রান্সফার পদ্ধতিতে নিজস্ব টার্মিনাল করবে এবং নিজেরা হ্যান্ডেল করবে। একটা সার্টেন পিরিয়ডের পর তারা বন্দরকে ট্রান্সফার করবে। বে টার্মিনালে যেটা হবে, বে টার্মিনালে ডিপি ওয়ার্ল্ড, পিএসএ এদের জিটুজি ভিত্তিতে ওরা পিপিপি অথরিটির মাধ্যমে কাজ করবে।
বে টার্মিনাল প্রকল্পে একটা মাল্টিপারপাজ কনটেইনার টার্মিনাল হবে, চট্টগ্রাম বন্দর উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে এই টার্মিনালটা নির্মাণ করার পরিকল্পনা করছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে চালু নিউমুরিং টার্মিনালে বিদেশি অপারেটর আসলে কী ধরনের পরিবর্তন আসবে বা নতুন কোন ধরনের সুবিধা হবে সেটি চুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি বা নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার পরিকল্পনা বেশ পুরোনো–– জানিয়েছেন মো. জাফর আলম, যিনি চট্টগ্রাম বন্দরে প্রশাসন ও পরিকল্পনা সদস্য পদে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন।
তিনি জানান, ২০১৭-১৮ সালের দিকে ডিপি ওয়ার্ল্ড সরকারকে এই পরিকল্পনা দিয়েছিল। তখন তাদের প্রস্তাবে বলা হয়–– এনসিটিতে বিনিয়োগ করবে, ঢাকা-চট্টগ্রাম ফ্রেইট কোরিডোরকে আরো স্মুথ করবে।
“এছাড়া আমাদের রেলওয়েতে খুব কম পরিমাণ পণ্য পরিবহন করা হয়, কারণ কমলাপুর আইসিডির ক্যাপাসিটি খুব কম। তাদের প্রস্তাব ছিল ধীরাশ্রমে একটা আইসিডি করবে এবং পুবাইল থেকে একটা লুপ লেইন এগারো কিলোমিটার ধীরাশ্রম যাবে; সেখানে কনটেইনারগুলো নামাবে।”
“বন্দর তখনই এফিশিয়েন্ট হবে যখন তার পশ্চাদভূমির সঙ্গে ডেডিকেটেট সংযোগ হয় বা কানেকটিভিটি থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের এটা নেই। এই প্রস্তাবটাও ডিপি ওয়ার্ল্ড দিয়েছিল। এই তিনটা একসাথে। এখন এনসিটি যদি শুধু ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়া হয়, আর অন্যগুলোকে অ্যাড্রেস না করা হয় তাহলে কিন্তু খুব একটা লাভ হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না।”
বিদেশি অপারেটর নিয়োগ দেওয়ার সমালোচনা প্রসঙ্গে মো. জাফর আলম বলেন, বন্দর বিক্রি হয়ে যাচ্ছে এমন সমালোচনা হয়। আসলে বিদেশি অপারেটর নিয়োগ মানেই বন্দর বিক্রি করা না।
বন্দর ব্যবস্থাপনা ভেঙে দেখলে একটি জাহাজ আসবে, দেশের সীমানায় ঢুকবে, ওখান থেকে আউটার অ্যাঙ্করেজে আসবে, তারপরে ভেড়ার পরে কেবল কনটেইনার নামানোর কাজটাই হলো অপারেটরের কাজ।
জাফর আলম বলেন, গ্রিনফিল্ড (নতুন নির্মাণ) টার্মিনাল আমাদের জন্য খুবই ভালো। কিন্তু এনসিটির মতো টার্মিনাল যদি আমরা দেই অনেক হিসাব-নিকাশ করে দিতে হবে। কারণ ওখানে আমাদের অনেক বিনিয়োগ আছে। এবং যদি এই হিসাব-নিকাশে ভুল হয় তাহলে আমাদের ক্ষতি হতে পারে।
চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ওপর মাশুল বা ট্যারিফ ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি এবং ডিসেম্বর মাসেই নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানির কাছে ছেড়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়ে বিতর্ক ও বিরোধিতা দেখা যাচ্ছে। বিদেশিদের সুবিধা করে দিতেই ট্যারিফ বাড়ানো হলো কি না এমন সমালোচনাও হচ্ছে।
জানা যায়, নিউমুরিং টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পেতে যাচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড এবং লালদিয়ার চরে নতুন টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার সুযোগ পাচ্ছে ডেনিশ কোম্পানি এপি মোলার মায়ার্স বা এপিএম।
এর মধ্যে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালটি বর্তমানে চালু রয়েছে। অন্যদিকে নতুন টার্মিনালটি হবে কর্নফুলী নদীর তীরে লালদিয়ার চর।
টার্মিনাল পরিচালনায় বিদেশি কোম্পানি নিয়োগের প্রস্তুতির মধ্যে বন্দর ব্যবহারে ৪১ শতাংশ ট্যারিফ বৃদ্ধি করে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। এই বর্ধিত মাশুল নিয়েও ঘোর আপত্তি তুলেছেন ব্যবসায়ীরা।
তাদের অভিযোগ, বিদেশি কোম্পানিকে বাড়তি সুবিধা দিতেই সরকার মাশুল বাড়িয়েছে। এছাড়া লাভজনক একটি চালু টার্মিনাল কেন বিনা দরপত্রে বিদেশি কোম্পানিকে ইজারা দেওয়া হবে সেই প্রশ্নও উঠছে।
তবে সরকার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর মাধ্যমে সরকারই লাভবান হবে।