শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৪২ অপরাহ্ন

গুজব দমন অ্যাপ এবার ভোটে আনছে এনটিএমসি

জাতীয় ডেস্ক
  • আপডেট টাইম: শনিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৫
সংগৃহীত ছবি | উত্তরা নিউজ

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং নির্বাচনী কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সভায়। গত ২০ অক্টোবর নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় গুরুত্বপূর্ণ প্রায় ৩৪টি প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন। সভায় সেনাবাহিনীর সদস্য মোতায়েন, প্রযুক্তি ব্যবহার করে গুজব মোকাবিলা এবং দুর্গম এলাকায় বিশেষ সুবিধার মতো বিষয়গুলোতে জোর দেওয়া হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের সভার উন্মুক্ত আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ছিল নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে। নির্বাচন পূর্ববর্তী তিন দিন, নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচন পরবর্তী চার দিনসহ মোট আট দিনের জন্য সারাদেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। একইসঙ্গে ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ সেনা সদস্যকে নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত করার প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। এর পাশাপাশি, সেনাবাহিনীকে সরকারের দেওয়া ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতার সঙ্গে বিচারিক ক্ষমতাও দেওয়ার জন্য আলোচনা হয়েছে বলে ইসির সভার কার্যবিবরণীতে উঠে এসেছে।

সশস্ত্র বাহিনী নির্বাচনে ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ হিসেবে থাকবে নাকি তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হিসেবে থাকবে, এই অবস্থান নির্ধারণ করতে নির্বাচন কমিশনকে আহ্বান জানানো হয়েছে। এই প্রস্তুতিমূলক সভার মধ্য দিয়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে কমিশনের কঠোর অবস্থানের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে করেন ইসি কর্মকর্তারা।

গুজব প্রতিরোধে বিশেষ ‘অ্যাপ’ ও প্রেস ব্রিফিং

সম্প্রতি সমাপ্ত হওয়া শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারে (এনটিএমসি) চালু করা একটি সফল মনিটরিং অ্যাপের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আসন্ন নির্বাচনের জন্য অনুরূপ একটি বিশেষ অ্যাপ তৈরি করার সুপারিশ করা হয়েছে। এই অ্যাপের মাধ্যমে গুজব ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানো রোধ করা সম্ভব হবে। এছাড়া ভুল তথ্য ও গুজব প্রতিরোধে নির্বাচন কমিশন থেকে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে সঠিক তথ্য পরিবেশনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

পার্বত্য ও উপকূলীয় এলাকায় বিশেষ ব্যবস্থা

পার্বত্য ও দুর্গম এলাকায় নির্বাচনী মালামাল এবং ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের পরিবহনের সুবিধার্থে হেলিপ্যাড প্রস্তুত রাখার নির্দেশনা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। সরঞ্জাম ও জনবল পরিবহনের জন্য পূর্বপরিকল্পনা গ্রহণ এবং সারা দেশের হেলিপ্যাডগুলো সংস্কার করে ব্যবহারের উপযোগী রাখতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়ার কথাও উঠে এসেছে। অন্যদিকে, উপকূলীয় এলাকার জন্য কার্যকর বাহিনী হিসেবে কোস্টগার্ডকে মোতায়েন করার সুপারিশ করা হয়েছে।

ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তা ও নজরদারি

ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রতি কেন্দ্রে অন্তত একটি করে ক্যামেরা স্থাপনের প্রস্তাব এসেছে। ঝুঁকিপূর্ণ, অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এবং সাধারণ ভোটকেন্দ্র চিহ্নিতকরণে ভোটকেন্দ্রের ভৌত অবকাঠামো, থানা থেকে দূরত্ব ও নিকটবর্তী প্রভাবশালীদের বাসস্থান ইত্যাদি বিবেচনায় নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া, প্রয়োজন অনুযায়ী ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও নির্বাচনী মালামালের রক্ষায় সেনাবাহিনীকে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের অনুমতির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সমন্বয়: কেন্দ্রীয় সমন্বয়ের মাধ্যমে নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করা এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় রেখে ব্যবহারের জন্য পরিবহন বিমান প্রস্তুত রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

কর্মকর্তা-কর্মচারী: নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা বাড়ানো এবং তাদের কার্যক্রম দৃশ্যমান করার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই স্থানে দীর্ঘদিন নিয়োজিত কর্মকর্তাদের এলাকা থেকে সরিয়ে অন্যত্র বদলির প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করা হয়েছে।

আনসার সদস্য: মোট আট দিনের জন্য আনসার সদস্যদের মোতায়েন এবং আনসার নিয়োগে অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্তদের বাদ দিয়ে প্রশিক্ষিত আনসারের ডাটাবেজ তৈরি করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

dhakapost

ইসি কর্মকর্তারা জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সভায় ইসির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আসন ছিল ৩০০টি, যা ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০টি আসন থাকবে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে পুরুষ ভোটার ছিল ৬ কোটি ১১ লাখ ৬২ হাজার, যা আগামী সংসদ নির্বাচনে ৬ কোটি ৩৯ লাখ ২৮ হাজার ৮০৯ জন হবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহিলা ভোটার ছিল ৫ কোটি ৮৮ লাখ ৩৪ হাজার ১০৩ জন, যা ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৬ কোটি ২৩ লাখ ৬ হাজার ১৭৭ জন হবে। এছাড়া, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হিজড়া ভোটার ছিল ৮৫১ জন, যা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১ হাজার ১৮৫ জনে। নারী, পুরুষ ও হিজড়া মিলে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ কোটি ৬২ লাখ ৩৬ হাজার ১৭১ জন, যা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ছিল ১১ কোটি ৯৭ লাখ ৬০ হাজার ৭৯০ জন।

ইসির কর্মকর্তারা জানান, এই সাড়ে ১২ কোটির বেশি ভোটার ৪২ হাজার ৬১৮টি ভোটকেন্দ্রে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন, যা গত সংসদ নির্বাচনে ছিল ৪২ হাজার ১৪৮টি। সেই সঙ্গে আসন্ন নির্বাচনে এই ভোটকেন্দ্রগুলোর মধ্যে মোট ভোটকক্ষ থাকবে ২ লাখ ৪৪ হাজার ৪৬টি, যা গত নির্বাচনে ছিল ২ লাখ ৬১ হাজার ৫৬৪টি। অর্থাৎ, আগামী সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র বাড়লেও ভোটকক্ষ কমেছে।

সংস্থাটি আরও জানায়, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ৬৬ জন। গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২ জন বিভাগীয় কমিশনার ও ৬৪ জন জেলা প্রশাসক রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, যা ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য কমিশন এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। এছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ৫৯২ জন। এর মধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ৪৯৫ জন, স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক ১৪ জন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ৮ জন, জোনাল এক্সিকিউটিভ অফিসার ১১ জন, উপজেলা নির্বাচন অফিসার ৫৬ জন এবং অন্যান্য ৮ জন দায়িত্ব পালন করেছেন। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের বিষয়েও কমিশন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছে ইসি।

dhakapost

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক শেষে ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ জানান, নির্বাচন কমিশনের এবার ভোটে ৫ দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাখার পরিকল্পনা ছিল। তবে বৈঠকে ৮ দিন রাখার প্রস্তাব এসেছে। এটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। ভোটের আগে তিন দিন, ভোটের দিন ও ভোটের পরে নিরাপত্তায় থাকবেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

ইসি সচিব জানান, আসন্ন সংসদ নির্বাচন নিয়ে কোনো শঙ্কা প্রকাশ করেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধানরাও কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেননি। নিরাপত্তা পরিকল্পনার অনেক কিছু নির্বাচনে বাজেটের ওপর নির্ভর করবে। বাজেট বরাদ্দের বিষয়টি পরে সিদ্ধান্ত হবে। বৈঠক থেকে কোনো ধরনের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি বলে জানান তিনি।

ইসির পরিকল্পনা অনুযায়ী, রোজার আগে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন হবে, ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণা করবে ইসি। সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও ৮ দিনের জন্য মাঠে নেমেছিল সশস্ত্র বাহিনী। তবে যাতায়াতের জন্য আরও পাঁচ দিন সময় নিয়েছিল। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ১০ দিন মাঠে নেমেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার রহমানেল মাছউদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, নির্বাচনকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে গুজব ছড়ালে তা কঠোরভাবে দমন করা হবে। বিশেষ করে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বা ডিজিটাল মাধ্যমে নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো গুজবের অপব্যবহার হলে, তা দমনে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) একটি নতুন ধারা যুক্ত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এই অপরাধে সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত জেলের বিধান রাখা হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে রহমানেল মাছউদ বলেন, এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) বা ডিজিটাল মাধ্যমে নির্বাচনসংক্রান্ত কোনো গুজবের ব্যাপার যদি ব্যবহৃত হয়, তাহলে আমরা আরপিওতে (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) একটি ধারা যুক্ত করেছি। সেখানে বলছি, এরকম হলে সেটা ‘অপরাধ প্র্যাকটিস’ হিসেবে গণ্য হবে এবং ওই আইনে বর্ণিত অনুযায়ী সাত বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, আরপিওতে বিশেষ আইন করার পাশাপাশি এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে সাধারণ আইন হিসেবে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট (সিএসএ) রয়েছে। তার আওতায়ও মামলা হতে পারে।

নির্বাচন কমিশনার গুজব ছড়ানোর বিষয়টিকে কেবল বাংলাদেশের নয়, বরং একটি ‘গ্লোবাল প্রবলেম’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই প্রবলেম প্রতিরোধ ও অপরাধীদের যথোপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্য সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ একাধিক আইন এবং সংস্থা কাজ করছে।

তিনি বলেন, এটা তো একটা সাধারণ বিষয়, আর আমাদের আরপিওতে আমরা একটি আর্টিকেল যোগ করে দিয়েছি। যেমন, নির্বাচনের ক’দিন আগে হঠাৎ করে বলা হয় যে, অমুক ক্যান্ডিডেট তো প্রত্যাহার করেছে। সেটাকে আমরা চেক করার জন্য আইনগত শাস্তির বিধান করছি।

অপরাধীদের তদন্ত ও শনাক্তকরণের বিষয়ে তিনি জানান, বিটিআরসি, পুলিশ, সিআইডিসহ অন্যান্য সংস্থা তাদের মতো করে ধরার জন্য চেষ্টা করবেন।

গুজব ও অপপ্রচার দমনে সরকারের সংস্থাগুলোর প্রযুক্তিগত সক্ষমতা প্রসঙ্গে তিনি এনটিএমসির অ্যাপ পূজার ক্ষেত্রে সফল হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। জ্যেষ্ঠ এই কমিশনার বলেন, এটাকে প্রতিরোধ করার জন্য বা শনাক্তকরণের জন্য কে করল সেটা বিষয় নয়। এটা নিয়ে সরকার যত রকম কাজ করবে, সেটা নির্বাচন কমিশনের জন্য ততই ভালো। যাতে কেউ এরকম করতে না পারে, আর করলে যাতে সে শনাক্ত হয় এবং তার শাস্তি হয়।

নিউজটি শেয়ার করুন..

  • Print
  • উত্তরা নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন:
এ জাতীয় আরো খবর..
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৩-২০২৫ | Technical Support: Uttara News Team
themesba-lates1749691102