সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:২০ অপরাহ্ন

নিকুঞ্জে ড্যান্ডিখোর আতঙ্ক: মাদকের ফাঁদে তলিয়ে যাচ্ছে পথশিশুরা

উত্তরা নিউজ
  • আপডেট টাইম: মঙ্গলবার, ৭ অক্টোবর, ২০২৫
ফাইল ছবি: উত্তরা নিউজ

ঢাকার অভিজাত এলাকা উত্তরা নিকুঞ্জ-২—একসময় শান্তিপূর্ণ, পরিপাটি ও নিরাপদ আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল। এখন সেখানে ফুটপাতজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এক ভয়াবহ দৃশ্য—পথশিশুরা হাতে পলিথিনে ভরা ‘ড্যান্ডি গাম’ নিয়ে প্রকাশ্যেই নেশা করছে। প্রতিদিন বিকেল গড়াতেই শুরু হয় এই ভয়ঙ্কর আসর। আর সমাজ, প্রশাসন ও অভিভাবক—সবাই যেন নির্বিকার দর্শক

ফুটপাতে বসে শিশুর নেশা—এক নির্মম বাস্তবতা

নিকুঞ্জের এক ফুটপাতে বসে সাত-আট বছরের এক শিশু। দূর থেকে মনে হয় কিছু খাচ্ছে। কাছে যেতেই দেখা যায়—পলিথিনে গাম নিয়ে মুখে দিয়ে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে। নাম জিজ্ঞেস করলে জানায়, “আমি রাব্বি। বাপ-মা নাই, তাই ড্যান্ডি খাই।” শিশুটির একটিমাত্র বাক্যে যেন সমাজের নির্মম চিত্র ফুটে ওঠে—ক্ষুধা, নিঃসঙ্গতা আর নেশার অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া শৈশব।

ড্যান্ডি: সস্তা কিন্তু প্রাণঘাতী নেশা

‘ড্যান্ডি গাম’ মূলত জুতা তৈরি ও যন্ত্রাংশ মেরামতে ব্যবহৃত আঠা। কিন্তু আজ সেটিই অল্পবয়সী শিশুদের সস্তা নেশার উপকরণ। মাত্র ৫–১০ টাকায় এটি কেনা যায় যে কোনো হার্ডওয়্যার বা পার্টস দোকান থেকে। পলিথিনে ঢেলে শোঁকার পর মুহূর্তেই মাথা ঝিমঝিম করে, শিশুরা ঢলে পড়ে নেশায়। গন্ধ কম হওয়ায় তারা প্রকাশ্যেই নেশা করে—মেরিডিয়ান হোটেলের আশেপাশে, ফুটওভার ব্রিজের নিচে কিংবা খাঁপাড়ার রেললাইনে—প্রতিদিনই চলছে এই দৃশ্য।

‘ড্যান্ডিখোর গ্যাং’: নতুন সামাজিক সংকট

স্থানীয়দের অভিযোগ, এখন এই কিশোররা “ড্যান্ডিখোর গ্যাং” নামে পরিচিত। তারা দিন-রাত ফুটপাতে আড্ডা দেয়, প্রকাশ্যে নেশা করে এবং মাঝে মাঝে ঘটে ছিনতাই বা মোবাইল চুরির ঘটনা। নিকুঞ্জবাসীর কাছে এটি এখন এক মহা আতঙ্কে পরিণত হয়েছে।

প্রশাসনের নীরবতা: অজুহাতের আড়ালে অসহায় বাস্তবতা

খিলক্ষেত থানার এক কর্মকর্তার ভাষ্য—“অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় আইনগতভাবে তাদের গ্রেপ্তার করা যায় না।” তারা শিশু সংশোধনাগারের পরামর্শ দিলেও, সেখানে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় কোনো কার্যকর ফল মিলছে না। ফলে প্রতিদিন নতুন নতুন শিশু যুক্ত হচ্ছে এই অন্ধকারের জগতে—আজ ড্যান্ডি, কাল গাঁজা, পরশু ইয়াবা।

সহজলভ্যতাই মূল বিপদ

রাজধানীর প্রায় প্রতিটি হার্ডওয়্যার ও জুতার উপকরণ বিক্রেতা দোকানে সহজেই পাওয়া যায় ড্যান্ডি গাম। কোনও বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ, বয়স যাচাই বা সরকারি নজরদারি নেই। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন—এখনই নিয়ন্ত্রণ না আনলে এটি রাজধানীর অন্যান্য এলাকায়ও মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়বে।

সমাধানের পথ

সমাজকর্মী ও স্থানীয়দের মতে, এই সংকট মোকাবিলায় এখনই নিতে হবে তিনটি জরুরি পদক্ষেপ—

  • ড্যান্ডি গাম বিক্রিতে লাইসেন্স ও সরকারি নিয়ন্ত্রণ চালু করা।
  • নেশাগ্রস্ত শিশুদের পুনর্বাসন, কাউন্সেলিং ও শিক্ষামূলক কর্মসূচি চালু করা।
  • প্রশাসন, এনজিও ও স্থানীয় কমিউনিটির যৌথ সচেতনতা অভিযান।

শেষ কথা

নিকুঞ্জের ফুটপাতে ড্যান্ডি হাতে বসে থাকা শিশুরা আজকের সমাজের অন্ধকার প্রতিচ্ছবি। এরা আমাদের চোখে ছোট, কিন্তু আগামী দিনের নাগরিক। আজ যদি আমরা তাদের অবহেলা করি, কাল তারা হারিয়ে যাবে অপরাধ ও মাদকের অচলায়তনে। এখনই দরকার কার্যকর ও মানবিক উদ্যোগ—কারণ, এই শিশুরা সহানুভূতি নয়, চায় একটি নিরাপদ, আলোকিত ভবিষ্যৎ।

লেখক: জাহিদ ইকবাল

সাংবাদিক ও সামাজিক কর্মী, নিকুন্জ, ঢাকা

ই-মেইল: jahidikbal@gmail.com

নিউজটি শেয়ার করুন..

  • Print
  • উত্তরা নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন:
এ জাতীয় আরো খবর..
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৩-২০২৫ | Technical Support: Uttara News Team
themesba-lates1749691102