জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের অন্যতম প্রধান উপাদান হচ্ছে একটি কার্যকর ও গতিশীল গ্রন্থাগার। সভ্যতার ক্রমবিকাশে গ্রন্থাগার এক অনন্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, যা শুধু বইয়ের সংগ্রহশালাই নয় বরং মানুষের মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের এক নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। রাজধানীর ব্যস্ততম ও পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা উত্তরায় এমনই এক প্রতিষ্ঠান উত্তরা পাবলিক লাইব্রেরি, যা স্থানীয় মানুষের জ্ঞানচর্চা ও পাঠাভ্যাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। উত্তরা পাবলিক লাইব্রেরি এমনই এক প্রতিষ্ঠান, যা উত্তরার মানুষের কাছে আজ শুধু একটি পাঠাগার নয়, বরং একটি জ্ঞানের বাতিঘর।
উত্তরা দীর্ঘদিন ধরে একটি আবাসিক, শিক্ষাবান্ধব ও সাংস্কৃতিক এলাকা হিসেবে পরিচিত হলেও, একটি আধুনিক মানসম্পন্ন লাইব্রেরির অভাব ছিল স্পষ্ট। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার সহায়ক স্থান,সাহিত্যপ্রেমীদের মিলনমেলা এবং সাধারণ পাঠকদের জ্ঞানচর্চার সুযোগ করে দেওয়ার লক্ষ্যে ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে উত্তরা পাবলিক লাইব্রেরি। এটি উত্তরা ১০ নাম্বার সেক্টরের ১ নাম্বার রোডের ৪ নাম্বার বাসায় অবস্থিত। এই পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা হলেন—মোহাম্মদ তারেকউজ্জামান খান। তাছাড়াও এর পেছনে কাজ করেছে একদল সংস্কৃতিমনা মানুষ, যারা বইকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করেন এবং সমাজে পাঠাভ্যাস বৃদ্ধিকে একটি আন্দোলন হিসেবে দেখেন।
গ্রন্থাগারকে বলা হয় ‘জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়’কারণ এটি সকল শ্রেণির মানুষের জন্য জ্ঞান আহরণের উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম। উত্তরা পাবলিক লাইব্রেরিও সেই ঐতিহ্যই বহন করে চলছে। এখানে শিশুকিশোর, যুবক, গৃহিণী থেকে শুরু করে প্রবীণ পাঠকরাও সমানভাবে বই পড়ার সুযোগ পান। লাইব্রেরির প্রায় ২০ হাজার বই-এর সমৃদ্ধ সংগ্রহে রয়েছে বাংলা ও ইংরেজি ভাষার সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস, জীবনী, রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, শিল্প-সংস্কৃতি, শিশুতোষ রচনা এবং সমসাময়িক জ্ঞানভিত্তিক বই। লাইব্রেরিটি খোলা থাকে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। এখানে প্রতিদিন গড়ে ৬০-৭০ জন পাঠক উপস্থিত থাকেন। লাইব্রেরিতে রয়েছে ৫০টি আসন। প্রতিটি কক্ষ রয়েছে সিসি ক্যামেরার আওতায়, রয়েছে আইপিএস সুবিধা, যাতে পাঠ কার্যক্রম কোনো প্রকার বাধা ছাড়াই চলতে পারে।
উত্তরা পাবলিক লাইব্রেরি শুধু বই ধার দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এখানে পাঠকদের জন্য পড়ার নিরিবিলি পরিবেশ, রেফারেন্স সেকশন, শিশুকিশোর কর্নার, এবং বিভিন্ন সময় পাঠাভ্যাস বৃদ্ধিমূলক কর্মসূচি পরিচালিত হয়। লাইব্রেরিটি নিয়মিতভাবে পাঠচক্র, কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতা, সাহিত্যসভা, সৃজনশীল লেখালেখির কর্মশালা ইত্যাদি আয়োজন করে থাকে। এসব আয়োজন উত্তরার মানুষদের মাঝে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করছে এবং নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলছে একজন সচেতন, সংবেদনশীল ও শিক্ষিত নাগরিক হিসেবে।
বর্তমান যুগে যখন তরুণ প্রজন্ম স্মার্টফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইউটিউবনির্ভর হয়ে পড়ছে, তখন বইয়ের প্রতি তাদের আকর্ষণ কমে যাওয়া এক বড় চ্যালেঞ্জ। এই পরিস্থিতিতে উত্তরা পাবলিক লাইব্রেরি এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা করেছে। লাইব্রেরি শিশু-কিশোর এবং তরুণদের বইমুখী করতে নানা রকম সৃজনশীল কৌশল ও কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এর মাধ্যমে অপসংস্কৃতি প্রতিরোধ করে সুস্থ ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন একটি সমাজ গড়ার দিকেই তারা এগিয়ে চলেছে।
লাইব্রেরির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আজীবন শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করা। যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে আছেন কিংবা কর্মজীবনে ব্যস্ত, তাদের জন্য লাইব্রেরি হচ্ছে জ্ঞানচর্চার দ্বিতীয় ঠিকানা। এখানকার পাঠকসেবা, বইয়ের বৈচিত্র্য ও সহায়ক পরিবেশ তাদের নিয়মিত পাঠাভ্যাসে উদ্বুদ্ধ করছে। বিশেষ করে যাঁরা চাকরি বা ব্যবসার ফাঁকে মানসিক প্রশান্তির জন্য বই পড়তে চান, তাঁদের জন্য লাইব্রেরির অবদান অনস্বীকার্য।
উত্তরা পাবলিক লাইব্রেরি শুধু বই পড়ার স্থান নয়; এটি এখন উত্তরার সাংস্কৃতিক মিলনমঞ্চ। লাইব্রেরিতে নিয়মিত কবিতা পাঠ, সাহিত্য আলোচনা, ইতিহাস ও সমাজবিষয়ক সেমিনার আয়োজন করা হয়। স্থানীয় লেখক, কবি, গবেষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের অংশগ্রহণে এসব অনুষ্ঠান একদিকে যেমন সাহিত্যচর্চা বাড়ায়, অন্যদিকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে উৎসাহ জাগিয়ে তোলে।
এই লাইব্রেরির কাজ শুধু বই পড়ার সুযোগ দেওয়া নয়; এটি সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালনের একটি অনন্য উদাহরণও বটে। প্রতিবছর এখানে গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান, সেরা শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা, মুক্তিযোদ্ধা ও হাফেজে কোরআনের সম্মাননা, রত্নগর্ভা মা ও গর্বিত বাবাদের স্বীকৃতি, পাশাপাশি সেরা শিক্ষক ও গুণী সাহিত্যিকদের সম্মানিত করা হয়। এসব আয়োজন শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে এবং সমাজে ইতিবাচক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
উত্তরা পাবলিক লাইব্রেরির মূল লক্ষ্য শুধুমাত্র পাঠাভ্যাস বাড়ানো নয় বরং সৃজনশীল মানুষ গড়ে তোলা। কারণ, সৃজনশীলতা ছাড়া একটি জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে উত্তরা পাবলিক লাইব্রেরি পাঠকদের চিন্তা-চেতনায়, মননে ও মানসিক বিকাশে অবদান রাখছে।
একটি গ্রন্থাগার তখনই পূর্ণতা পায়, যখন তা প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে এবং সময়োপযোগী সেবায় সমৃদ্ধ হয়। উত্তরা পাবলিক লাইব্রেরিও ভবিষ্যতে ডিজিটাল লাইব্রেরি সেবা, ই-বুক সংগ্রহ, অনলাইন বুকিং সিস্টেম, অডিও-বুক কর্নার ইত্যাদি চালুর পরিকল্পনা করেছে। এসব আধুনিক উদ্যোগ উত্তরা অঞ্চলে জ্ঞানচর্চার গতিকে আরও ত্বরান্বিত করবে।
গ্রন্থাগার হলো একটি জাতির জ্ঞানভাণ্ডার। উত্তরা পাবলিক লাইব্রেরি সেই জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে উত্তরার পাঠকদের মাঝে। পাঠকদের মধ্যে পাঠাভ্যাস সৃষ্টি, সামাজিক মূল্যবোধ জাগ্রতকরণ এবং নতুন প্রজন্মকে জ্ঞান-ভিত্তিক সমাজের সদস্য হিসেবে গড়ে তোলার যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এটি যাত্রা শুরু করেছিল, তা বর্তমানে দৃশ্যমান বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে। উত্তরা পাবলিক লাইব্রেরি শুধু একটি পাঠাগার নয় এটি“উত্তরাবাসীর জ্ঞানের বাতিঘর” হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে।