মদিনার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নৈতিকতার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কোরআন ও হাদিসের অসংখ্য বাণীতে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, আস্থা, উদারতা ও সহমর্মিতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। নবী (সা.) বলেছেন : ‘আল্লাহ রহমত করুন সেই ব্যক্তির ওপর, যে বিক্রি, ক্রয় ও ঋণ আদায়ে উদার থাকে।’ (বুখারি, হাদিস : ২০৭৬)ইবনে বাত্তাল উল্লেখ করেছেন, সততা ও উদার আচরণ বরকতের অন্যতম কারণ।
কর্মপ্রবণতা ও পরিশ্রমের গুরুত্ব
ইসলাম মুসলমানদের পরিশ্রম ও উৎপাদনশীলতার প্রতি উৎসাহিত করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন : ‘তিনিই তো তোমাদের জন্য জমিনকে সুগম করে দিয়েছেন; অতএব, তোমরা এর দিগদিগন্তে বিচরণ করো এবং তাঁর দেওয়া রিজিক থেকে আহার করো।’ (সুরা : মুলক, আয়াত : ১৫)
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যখন নামাজ শেষ হবে, পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অনুসন্ধান করো।’ (সুরা : জুমুয়া, আয়াত : ১০)।
নবী (সা.) বলেন, ‘কেউ নিজের হাতে অর্জিত খাবার খাওয়ার চেয়ে উত্তম আর কিছু নেই।’ (বুখারি, হাদিস : ২০৭২)
অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যদি কেউ জোড়া কাঠ বহন করে, তা ভিক্ষার চেয়ে উত্তম।’ (বুখারি, হাদিস : ২০৭৪)
এসব আয়াত ও হাদিস মুসলমানদের শিক্ষা দেয়— পরিশ্রম ও কাজই জীবনের মূল চাবিকাঠি এবং অর্থনীতির শক্তিশালী চালিকা।
মদিনায় জমি চাষ ও দখলনীতি
মুহাজির ও আনসাররা মদিনায় এসে পরিশ্রম ও উৎপাদনে সক্রিয় হন। আসহাবে সুফফা হাদিস শিক্ষায় নিয়োজিত থাকতেন আর আনসাররা তাঁদের কৃষিজমিতে কাজ করতেন। নবী (সা.) ঘোষণা করেছিলেন—‘যে ব্যক্তি শূন্য বা মরুভূমির জমি চাষ করে জীবিত করে, তা তার হয়ে যায়।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৫৫০)
খাইবার বিজয়ের পর নবী (সা.) জমি বিতরণ করে তার আয় দিয়ে মুসলিমদের ব্যয় ও শহরের উন্নয়ন করতেন। সে সময় গুরুত্বপূর্ণ উপত্যকা ও খামার যেমন—ওয়াদি আল-আকিক ও তায়েফে কৃষি প্রসারিত হয়। এভাবে নবী (সা.)-এর সময়ে জমি চাষ, উৎপাদন ও সম্পদ বিতরণ ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল অংশ হিসেবে কার্যকর ছিল।
মদিনায় সেচ ও জল বণ্টন ব্যবস্থাপনা
মুহাজির ও আনসারের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও জমি বরাদ্দের পর নবী (সা.) জল ও সেচ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার নিয়ম স্থাপন করলেন। তিনি বৃক্ষ সংরক্ষণের নির্দেশ দেন—‘যে ব্যক্তি একটি গাছ কাটবে, সে তার স্থানে নতুন গাছ লাগাবে।’
ওয়াদিয়ে মুহজুরে নবী (সা.) নির্ধারণ করলেন যে পানি জমিতে দুই কনুই পর্যন্ত আটকে রাখা হবে, পরে অন্য অংশে পাঠানো হবে, যাতে ওপরের জমি নিচের জমিকে বাধা না দেয়। এই সুশৃঙ্খল জল, জমি ও বাজার ব্যবস্থা কৃষি, পেশা ও কারুশিল্পকে উৎসাহ দিত এবং মদিনার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করত।
মদিনার বাণিজ্য উন্নয়ন
নবী (সা.) মুসলমানদের বাণিজ্যে সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও প্রচেষ্টার প্রতি উৎসাহিত করতেন। মুসলিমরা ব্যাবসায়িক লেনদেনে নৈতিকতার সঙ্গে কাজ করত এবং অমুসলিমদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করত। তিনি প্রতিনিধি পাঠানোর সময় ইসলামের অর্থনৈতিক নীতি প্রচার করতেন। অর্থনীতির বিকাশে নবী (সা.) দান, ত্রাণ ও জনসংখ্যা হিসাবের ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। ইসলামী অর্থনীতির মূল কেন্দ্র ছিল কৃষি ও বাণিজ্য। চাষাবাদ, বৃক্ষরোপণ ও উদ্যানায়নকে সাদাকা হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছিল। পশু পালন ও শিল্পকর্মও অর্থনৈতিক কাঠামোর অংশ ছিল। লোহা, অস্ত্র ও অন্যান্য শিল্প, যেমন—গহনা, বোনা, দর্জি, কাঠ ও তামার কারিগরি তখনকার সমাজে গুরুত্বপূর্ণ পেশা ছিল।
তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘সবচেয়ে উত্তম উপার্জন হলো শ্রমিকের সততার সঙ্গে উপার্জন।’ (বুখারি, হাদিস : ২০৭২)
এটি দক্ষ কারিগরদের উৎসাহ দেওয়া ও শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের উদ্যোগ ইসলামী অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছিল।
সমতা ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা
সমতা ও সামাজিক ন্যায়ের লক্ষ্যে ইসলামে করের বোঝা সীমিত করা হয়েছে—মুসলিমদের ওপর জাকাত আর অবিশ্বাসীদের ওপর জিজিয়া ধার্য করা হয়েছে। যেগুলোর মাধ্যমে সম্পদের ন্যায্য বণ্টন ও ধনী-গরিবের ব্যবধান হ্রাস পায়। নবী (সা.) মুনাফার অবৈধ শোষণ (মকস) নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং সবাইকে সৎকর্ম, দান ও সহায়তার প্রতি উৎসাহিত করেছিলেন।
আর্থিক তদারকি
নবী (সা.)-এর সময়ে আর্থিক নীতি ও তদারকি ছিল সুসংগঠিত এবং সততার ভিত্তিতে পরিচালিত। হিজরতের পর তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের শাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করলে আয়ের উৎস, ব্যয় ও তদারকি নির্ধারণ করলেন। তিনি জাকাত ও সাদাকাহ সংগ্রহের দায়িত্বে সাহাবাদের সতর্ক করতেন এবং দুর্নীতি ও অসৎ ব্যবহার থেকে কঠোরভাবে বিরত রাখতেন।
রাষ্ট্রীয় ব্যয় দ্রুত ও প্রয়োজনমতো বিতরণ হতো; গরিব ও অসহায়দের জন্য দান বা জিহাদে ব্যবহার হতো। রাষ্ট্রীয় কোষাধ্যক্ষদের মাধ্যমে অর্থ সংরক্ষণ ও তদারকি করা হতো। আয়ের উৎস ও ব্যয়ের নিয়ম নির্দেশ করে কোরআনে এসেছে—‘মানুষের অধিকার হ্রাস কোরো না এবং পৃথিবীতে ফ্যাসাদ কোরো না।’ (সুরা : আশ-শুআরা, আয়াত : ১৮৩)
ইসলামী রাষ্ট্রের আয়ের উৎস
ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান আয়ের উৎস ছিল ছয়টি—
১. জাকাত : এটি মুসলিমদের ওপর ফরজ এবং রাষ্ট্রের প্রধান আয়ের উৎস। দরিদ্র, ঋণগ্রস্ত, পথিক ও অন্যান্য ব্যয় নিশ্চিত করার জন্য তা ব্যবহৃত হতো। (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৬০)
২. গনিমত/যুদ্ধলব্ধ সম্পদ : যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ, যেখানে ভাগ্য নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিতভাবে বিতরণ হতো। (সুরা : আনফাল, আয়াত : ৪১)
৩. ফায়/শত্রুর সম্পদ : শত্রুর সম্পদ—যা যুদ্ধ ছাড়াই অধিগৃহীত হয়। এগুলো রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য ব্যয় করা হতো। (সুরা : হাশর, আয়াত : ৬-৭)
৪. জিজিয়া : অমুসলিমদের ওপর নির্ধারিত কর, যারা শান্তিপূর্ণভাবে রাজ্যে থাকার অধিকার নিশ্চিত করে।
(সুরা : তাওবা, আয়াত : ২৯)
৫. দান ও ওয়াক্ফ : মসজিদ নির্মাণ, কূপ খনন ও সাধারণ কাজের জন্য ব্যক্তিগত ত্যাগ ও দান।
৬. ঋণ : রাষ্ট্রের জরুরি প্রয়োজনে গ্রহণ করা ঋণ, পরে ফেরত প্রদান নিশ্চিত করা হতো।