শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫, ০২:২৯ অপরাহ্ন

গণমাধ্যমে কথা বলার নীতি ও শিষ্টাচার

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট টাইম: শুক্রবার, ২৫ জুলাই, ২০২৫

 

বিভিন্ন বিষয়ে সংবাদ একত্র করে তা সম্পাদনার পর মানুষের সামনে প্রকাশ করাই গণমাধ্যমের প্রধান কাজ। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক উভয় ধরনের মিডিয়া একই কাজ করে। যদিও তাদের কর্মপদ্ধতি ও সংবাদ প্রচারের কৌশলে ভিন্নতা আছে। শরিয়তের শর্ত মেনে সংবাদ সংগ্রহ করা এবং তা প্রচার করা বৈধ কাজ।
কোনো সংবাদমাধ্যম যদি নেক নিয়তে কাজ করে, তবে আল্লাহর দরবারে তার প্রতিদান আশা করা যায়। আর যে গণমাধ্যম শরিয়তের সীমা রক্ষা না করে, পরকালে তাদের জবাবদিহি করতে হবে। যেমন—যাচাই ছাড়া সংবাদ প্রচার করা, অশালীন ও চরিত্র নষ্ট করে এমন বিষয় প্রচার করা, ইসলামবিরোধী বিষয় প্রচার করা, সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ ঘটানো, এমন সংবাদ প্রচার করা যা সমাজে বিরোধ উসকে দেয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে মানুষের দোষত্রুটি প্রচার করা ইত্যাদি।গণমাধ্যমে কথা বলার শিষ্টাচারগণমাধ্যমে, বিশেষত ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় অনেকেই অন্যের সমালোচনা করেন।টিভির টক শোগুলোতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে আলোচকদের নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিতে দেখা যায়। যেমন—ইচ্ছা করে মিথ্যা বলা, মিথ্যা দোষারোপ করা, চরিত্রহরণ করা, সত্যের সঙ্গে মিথ্যার মিশ্রণ ঘটানো অথবা সত্য কথাটিই এমনভাবে পেশ করা, যা কথকের উদ্দেশ্য পরিপন্থী। ইসলামের দৃষ্টিতে এমন কাজ সম্পূর্ণ নাজায়েজ। এ ক্ষেত্রে নীতি ও নির্দেশনা হলো—

১. গণমাধ্যমে কোনো কথা বলার আগে ভাবতে হবেএটা আমার জন্য বৈধ কি না? পরকালে জবাবদিহি করার ভয় অন্তরে রেখেই কথা বলা, কেননা মহান আল্লাহর সতর্কবাণী হলো, ‘যেদিন তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে তাদের জিহ্বা, তাদের হাত ও তাদের পা তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ২৪)

২. অন্যের সমালোচনা ও দোষত্রুটি ততক্ষণ করা যাবে না, যতক্ষণ না তা শরিয়ত বর্ণিত পদ্ধতিতে প্রমাণিত হবে। নতুবা এমন সমালোচনা ও দোষত্রুটি বর্ণনা অপবাদের অন্তর্ভুক্ত হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা! যদি কোনো পাপাচারী তোমাদের কাছে কোনো বার্তা নিয়ে আসে, তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে; যেন অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে বসো। আর পরে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদের অনুতপ্ত হতে হয়।’ (সুরা : হুজরাত, আয়াত : ৬)৩. যে বিষয়গুলো সমাজে অশ্লীলতা ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড উসকে দেয় তা গণমাধ্যমে বলা, প্রচার করা নিষিদ্ধ।

ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতে মর্মন্তুদ শাস্তি এবং আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না।’(সুরা : নুর, আয়াত : ১৯)৪. গণমাধ্যমে অনুমাননির্ভর, সমাজে বা সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত বিষয়গুলো যাচাই না করে প্রচার এবং বক্তব্যের অংশ বানানো মিথ্যাচারের নামান্তর। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো কথা শুনেই প্রচার করা ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।’(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৫)৫. কারো দোষত্রুটি শরিয়তের দৃষ্টিতে প্রমাণিত হওয়ার পর ভেবে দেখতে হবে, এর সঙ্গে মানুষের অধিকার জড়িত কি না? এই ত্রুটি প্রকাশ না পেলে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি না? মানুষের অধিকার ও সুরক্ষার বিবেচনায় তা প্রকাশ করা জায়েজ। নতুবা এই ব্যক্তিকে নীরবে সতর্ক করাই ইসলামের নীতি। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মন্দ কথার প্রচারণা আল্লাহ পছন্দ করেন না, তবে যার ওপর জুলুম করা হয়েছে সে ছাড়া। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’(সুরা : নিসা, আয়াত : ১৪৮)

৬. সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্য জনজীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করা। এই উদ্দেশ্য থেকে ভালো-মন্দ অবস্থার পর্যালোচনা করার প্রয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা হলো সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নাম উচ্চারণ না করে এভাবে বলা যে ‘সমাজের অনেকেই এই অপরাধ ও অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে।

৭. দেশের নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়, সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় অথবা সুনির্দিষ্ট কোনো শ্রেণি-গোষ্ঠীর জীবনে হুমকি তৈরি হয়—এমন বিষয় পরিহার করা আবশ্যক। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যখন শান্তি অথবা শঙ্কার কোনো সংবাদ তাদের কাছে আসে, তখন তারা তা প্রচার করে থাকে। যদি তারা তা রাসুল কিংবা তাদের মধ্যে যারা ক্ষমতার অধিকারী তাদের গোচরে আনত, তবে তাদের মধ্যে যারা তথ্য অনুসন্ধান করে তারা তার যথার্থতা নির্ণয় করতে পারত। তোমাদের প্রতি যদি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকত, তবে তোমাদের অল্পসংখ্যক ছাড়া সবাই শয়তানের অনুসরণ করত।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৮৩)

৮. আলোচনা, সমালোচনা, তর্ক-বিতর্কে যথাসম্ভব শিষ্টাচার ও ভদ্রতা বজায় রাখা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান করো হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সঙ্গে তর্ক করবে উত্তম পন্থায়।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১২৫)

এসব নীতি সামনে রেখে গণমাধ্যমে কথা বললে আশা করা যায় গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা যাবে।

অন্যের সমালোচনা কখন বৈধ?

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ মানুষের দোষত্রুটি প্রকাশের এক চমৎকার মূলনীতি ঘোষণা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘মন্দ কথার প্রচারণা আল্লাহ পছন্দ করেন না, যার ওপর জুলুম করা হয়েছে সে ছাড়া। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৪৮)

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে উসমানিতে লেখা হয়েছে, ‘যদি কারো দ্বিনি বা জাগতিক ত্রুটি জানা যায়, তবে তা প্রচার না করা উচিত। আল্লাহ তাআলা সব শোনেন এবং সবার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানেন। তিনি প্রত্যেককে তার কর্ম অনুসারে প্রতিদান দেবেন। অন্যের দোষত্রুটি প্রচার করা গিবত, যা নিষিদ্ধ ও হারাম। তবে কেউ মাজলুম হলে অবকাশ আছে। অবিচারকারীর অবিচার এবং অত্যাচারীর অত্যাচার মানুষের বলার অবকাশ আছে। যেন মানুষ অবিচার ও জুলুম থেকে বাঁচতে পারে। তেমনি আরো কিছু পরিস্থিতিতে গিবত বা সমালোচনা করার অনুমতি আছে। সম্ভবত এখানে এই নির্দেশ এ কারণে দেওয়া হয়েছে যে একজন মুসলমানের উচিত নয় কোনো মুনাফিকের (কপট ব্যক্তি) নাম প্রকাশ্যে প্রচার করা বা তাকে প্রকাশ্যে অপমান করা। এতে সে (মুনাফিক) উল্টো বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে, বরং পরোক্ষভাবে উপদেশ দেওয়া উচিত, যাতে মুনাফিক নিজেই তা বুঝে নিতে পারে, অথবা একান্তে তাকে উপদেশ দেওয়া উচিত। এতে হয়তো সে সুপথ গ্রহণ করতে পারে। এটাই মহানবী (সা.)-এর কর্মপদ্ধতি ছিল। তিনি কারো নাম প্রকাশ করে তাকে লাঞ্ছিত করতেন না।’ (তাফসিরে উসমানি : ১/৪৭৩)

আল্লাহ সবাইকে দ্বিনের পথে চলার তাওফিক দিন। আমিন।

নিউজটি শেয়ার করুন..

  • Print
  • উত্তরা নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন:
এ জাতীয় আরো খবর..
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৩-২০২৫ | Technical Support: Uttara News Team
themesba-lates1749691102