ইসরায়েলের দখলদারিত্ব, বর্ণবৈষম্য ও গণহত্যাকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা এবং তার থেকে লাভবান হওয়ার অভিযোগে বিশ্বব্যাপী কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন জাতিসংঘের এক বিশেষজ্ঞ। জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে উপস্থাপনযোগ্য একটি বিস্তৃত প্রতিবেদনে তিনি এসব কম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।জাতিসংঘের বিশেষ দূত ফ্রানচেস্কা আলবানিজে সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে গুগল, অ্যামাজন, মাইক্রোসফটসহ ৬০টির বেশি আন্তর্জাতিক কম্পানির নাম প্রকাশ করে অভিযোগ করেন। কম্পানিগুলো দখলদার অর্থনীতি থেকে গণহত্যার অর্থনীতিতে ইসরায়েলের রূপান্তরে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে বলে তিনি জানান।প্রতিবেদনে আলবানিজে লিখেছেন, ‘একটি চিরস্থায়ী দখলদারিত্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরার মাধ্যমে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, ফিলিস্তিন ভূখণ্ড হয়ে উঠেছে অস্ত্র প্রস্তুতকারক ও বিগ টেক কম্পানিগুলোর জন্য আদর্শ পরীক্ষাগার। বিনিয়োগকারী এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এই পরিস্থিতি থেকে স্বাধীনভাবে লাভ করে চলেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘অনেক প্রভাবশালী কম্পানি ইসরায়েলের বর্ণবাদ ও সামরিক দমননীতির সঙ্গে আর্থিকভাবে গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে।’
অস্ত্র, প্রযুক্তি, নির্মাণ ও জ্বালানি খাতে সংশ্লিষ্টতা
২৪ পৃষ্ঠার বিস্তারিত এই প্রতিবেদনটি আগামীকাল বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে উপস্থাপন করা হবে।
এতে অস্ত্র, প্রযুক্তি, নির্মাণ ও জ্বালানি খাতে যুক্ত কম্পানিগুলোর সরাসরি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আনা হয়েছে।
প্রতিবেদনে এলবিট সিস্টেমস, লকহিড মার্টিন-এর মতো অস্ত্র কম্পানি থেকে শুরু করে ক্যাটারপিলার ও এইচডি হুন্ডাই-এর মতো নির্মাণ যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলোর নাম এসেছে, যাদের পণ্য বেআইনি ইসরায়েলি বসতি নির্মাণে ব্যবহৃত হচ্ছে।
প্রযুক্তিকে দমনযন্ত্রে রূপান্তর
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড এখন একটি ‘অনন্য পরীক্ষাগার’ হয়ে উঠেছে যেখানে প্রযুক্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের দমন প্রক্রিয়া আরো স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠেছে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলের সামরিক ক্লাউড যখন ওভারলোড হয়ে পড়ে, তখন মাইক্রোসফট এবং অ্যাজুর গুগল-অ্যামাজন পরিচালিত প্রজেক্ট নিম্বাস তাতে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাউড এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) অবকাঠামো সরবরাহ করে।
এ ছাড়াও, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর জন্য যে এআই সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে তা গাজার যুদ্ধ চলাকালীন লক্ষ্য নির্ধারণ ও আক্রমণ পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। প্যালান্টির টেকনোলজিস ইনকর্পোরেটেড-এর সঙ্গে ইসরায়েলের সহযোগিতার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে, যারা রিয়েল-টাইম যুদ্ধক্ষেত্র তথ্য বিশ্লেষণের জন্য এআই প্ল্যাটফর্ম সরবরাহ করে বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
কম্পানিগুলোর প্রতিক্রিয়া
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬০টির বেশি কম্পানির মধ্যে ৪৮টি প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি এ বিষয়ে জানানো হয়েছে এবং ১৫টি প্রতিষ্ঠান সাড়া দিলেও তাদের জবাব প্রকাশ করা হয়নি।
লকহিড মার্টিন জানিয়েছে, তাদের অস্ত্র বিক্রি সরকার থেকে সরকার লেনদেনের মাধ্যমে হয়, তাই যুক্তরাষ্ট্র সরকার এই প্রশ্নের উত্তরে যথাযথ সংস্থা। আলবানিজের দপ্তর আরো জানিয়েছে, তদন্ত চলাকালীন তারা প্রায় ১ হাজার কম্পানির একটি তথ্যভাণ্ডার তৈরি করেছে, যা এই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক লাভ ও রাজনৈতিক চাপ
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, গাজার ওপর ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পর তেলআবিব স্টক এক্সচেঞ্জে বাজারমূল্য ১৭৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে ১৫৭.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নতুন বাজারমূল্য যোগ হয়েছে। অন্যদিকে, জেনেভায় অবস্থিত ইসরায়েলি দূতাবাস এই প্রতিবেদনকে ‘আইনি ভিত্তিহীন, মানহানিকর এবং দায়িত্বের অপব্যবহার’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
কঠোর পদক্ষেপের আহ্বান
আলবানিজে জাতিসংঘ সদস্য দেশগুলোকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থগিত করার আহবান জানিয়েছেন। এ ছাড়া ফিলিস্তিনিদের জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহবান জানিয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এবং জাতীয় আদালতগুলোর উচিত এসব কর্পোরেট নির্বাহীদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও বিচার করা, কারণ তারা আন্তর্জাতিক অপরাধে অংশগ্রহণ করেছে এবং সেই অপরাধের আয় লন্ডারিংয়ের সঙ্গেও যুক্ত। এই প্রতিবেদনটি বিশ্বব্যাপী কর্পোরেট স্বার্থ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি ভবিষ্যতের আন্তর্জাতিক আইন ও ব্যবসায়িক নৈতিকতায় গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
এ জাতীয় আরো খবর..