নবী করিম (সা.) শিশুদের চাহিদা ও অনুরাগ-অনুভূতির মূল্যায়ন করতেন। আদর-সোহাগ করে তাদের কাঁধে ওঠাতেন এবং তাদের শিশুসুলভ আচরণকে সহাস্যবদনে বরণ করে নিতেন।
নবী করিম (সা.) শিশুদের আনন্দ দিতেন, কাঁধে চড়িয়ে তাদের আহ্লাদ-আবদার পুরা করতেন। আবু কাতাদা (রা.) বলেন, একদিন আমরা মসজিদে বসা। নবীজি তাঁর কন্যা জয়নব (রা.)-এর মেয়ে উমামাকে কাঁধে করে আমাদের সামনে এলেন। (তিনি বলেন), এরপর নামাজের ইমামতি শুরু করলেন। উমামা তখনো নবীজির কাঁধে। রুকু করার সময় তাকে নামিয়ে রাখেন। সিজদা থেকে উঠে আবার উঠিয়ে নেন। পুরো নামাজ তিনি এভাবেই আদায় করলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৯৯৬; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৫৪৩)
শিশুদের সঙ্গে হাসি-আনন্দ
নবী করিম (সা.) কখনো কখনো শিশুদের সঙ্গে রসিকতা করতেন। হাসি-আনন্দ করতেন। আনাস (রা.) নবীজির খেদমত করতেন। তিনি ছিলেন খুব চঞ্চল। নবীজি রসিকতা করে তাঁকে দুই কানওয়ালা বলে ডাকতেন। আনাস (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) তাঁকে ‘হে দুই কানওয়ালা’ বলে ডেকেছেন। বর্ণনাকারী বলেন, নবীজি তাঁর সঙ্গে রসিকতা করে এভাবে ডেকেছেন।
(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৫০০২; জামে তিরমিজি, হাদিস : ২১০৯)
উম্মে সুলাইম (রা.)-এর এক সন্তানের নাম ছিল আবু উমাইর। ছোট্ট শিশু। তার একটা ‘নুগাইর’ পাখি ছিল। সে এটা দিয়ে খেলা করত। আনাস (রা.) বলেন, উম্মে সুলাইম (রা.)-এর এক ছোট্ট ছেলে ছিল। নাম আবু উমাইর। তার একটা ‘নুগাইর’ পাখি ছিল। নবী করিম (সা.) যখনই উম্মে সুলাইম (রা.)-এর ঘরে আসতেন আবু উমাইরের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করতেন। একদিন তার কাছে এসে দেখেন, তার মন খারাপ। বলেন, কী হলো আবু উমাইরের, মন খারাপ কেন? লোকেরা বলল, সে যে নুগাইর পাখিটা দিয়ে খেলা করত সেটা মারা গেছে। এর পর থেকে যখনই নবী করিম (সা.) তাকে দেখতেন, বলতেন, আবু উমাইর! তোমার নুগাইরটার কী হলো! (দেখছি না যে!) (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬২০৩; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২১৫০)
শিশুর ভুলভ্রান্তি হলে বিরক্তি প্রকাশ না করা
শিশুদের কথা, কাজ, চলাফেরা—সব কিছুতেই ভুল হওয়া স্বাভাবিক। তাদের ভুলভ্রান্তির জন্য ধমক দেওয়া, তিরস্কার করা বা বিরক্তি প্রকাশ করা ঠিক না। হ্যাঁ, কোমল শাসন তো করতেই হবে, যাতে সে সচেতন হয়। তবে তা হতে হবে সস্নেহ শাসন। সায়্যিদুনা আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, আমি ১০ (বা নয়) বছর নবী করিম (সা.)-এর খিদমত করেছি, আল্লাহর কসম! কোনো দিন আমাকে ‘উফ’ বলেননি। আমি (অযাচিত) কোনো কিছু করে ফেললে বলেননি—এটা কেন করলে? তেমনি কোনো কাজ না করলে বলেননি—এটা কেন করলে না? (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৩০৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৭৭৩)
শিশুদের খেলাধুলার সুযোগ দেওয়া
শিশুদের মন চঞ্চল। তারা খেলাধুলা করতে ভালোবাসে। তাদের সঙ্গে খেলাধুলা করে আনন্দ গ্রহণের সুযোগ দেওয়া নবী করিম (সা.)-এর আদর্শ। আয়েশা (রা.)-এর যখন বিবাহ হয় তখন তিনি ছোট ছিলেন। ফলে তিনি বান্ধবীদের সঙ্গে খেলতেন। তিনি বলেন, আমি নবী করিম (সা.)-এর ঘরে পুতুল দিয়ে খেলা করতাম। আমার কয়েকজন বান্ধবী আমার সঙ্গে খেলত। নবীজি ঘরে এলে তারা লজ্জায় লুকিয়ে যেত। তখন তিনি একজন একজন করে তাদের আমার কাছে পাঠাতেন। তারা আবার আমার সঙ্গে খেলতে শুরু করত। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬১৩০; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৪৪০)
শিশুদের ভীত ও আতঙ্কিত না করা
আবু লায়লা (রা.) বলেন, আমি রাসুলে করিম (সা.)-এর কাছে বসা ছিলাম। হাসান বা হুসাইন নবীজির বুকে বসা। হঠাৎ দেখি সে ফিনকি দিয়ে পেশাব করছে। (তাকে সরানোর জন্য) আমরা উঠলাম। তিনি বলেন, আমার ছেলেকে (নাতিকে) পেশাব শেষ করতে দাও। তাকে আতঙ্কিত কোরো না; পেশাব শেষ করতে দাও।
(মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৯০৫৯)
একটু ভাবুন, শিশুদের প্রতি নবীজির দিল-মন কত প্রশস্ত ছিল!
শিশুদের জন্য বদদোয়া না করা
সন্তান মাতা-পিতার মেজাজ-বিরুদ্ধ কিছু করলে তাঁরা যদি রাগ করে তার জন্য বদদোয়া করেন, আর আল্লাহ না করুন—তাঁদের দোয়া কবুল হয়ে যায়, তাহলে লাভের কী হলো! সন্তান, মাতা-পিতা সবার জন্যই তো ক্ষতি ও কষ্টের কারণ হলো! রাসুলে করিম (সা.) ফরমান—‘তোমরা নিজেদের জন্য বদদোয়া কোরো না। সন্তানদের জন্য বদদোয়া কোরো না। সম্পদের ওপর বদদোয়া কোরো না। (কারণ) এমন হতে পারে যে আল্লাহর কাছে দোয়া কবুল হওয়ার সময় তোমরা বদদোয়া করলে আর আল্লাহ তা কবুল করে নিলেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস ৩০০৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১৫৩২)
শিশুদের জন্য নেকদোয়া করা
শিশুদের প্রতি নবীজি (সা.)-এর মায়া-মমতা ছিল বর্ণনাতীত। তাদের কল্যাণ কামনা করতেন। তাদের জন্য উন্নতি ও বরকতের দোয়া করতেন। উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে মদিনার শিশুদের নিয়ে আসা হতো। নবীজি তাদের জন্য বরকতের দোয়া করতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৩৫৫)
শিশুর প্রতিপালনে আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।