পৃথিবীর ইতিহাস বলে, ক্রান্তিলগ্নে জাতিকে উদ্ধারে কোনো না কোনো একজন ক্ষণজন্মা বীর জন্ম নেন। আবু সাঈদ তেমনই একজন বীর। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে যিনি স্ফুলিঙ্গ হিসেবে কাজ করেছিলেন। তার জীবন বিলিয়ে দেওয়া আন্দোলনের গতিকে বদলে দিয়েছিল তুমুলভাবে।
আবু সাঈদের সঙ্গে থাকা বেরোবির ছাত্র এবং সংবাদকর্মী তাওহিদুল হক সিয়াম বলেন, আবু সাঈদ অত্যন্ত সাহসী, দৃঢচেতা এবং অন্যরকম একজন দেশপ্রেমিক মানুষ ছিলেন। পুলিশের বেপরোয়া রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস ও গুলিবর্ষণের সময় তার হাতে শুধু একটা সাধারণ লাঠি ছিল। তিনি সরে যাননি, কাঠের ব্রিজের পাশেই ছিলেন। এ সময় ৫/৬ জন পুলিশ তাকে ঘিরে ধরে বেধড়ক নির্যাতন ও রক্তাক্ত করে।
সিয়াম আরো বলেন, ‘আমি আবু সাঈদকে বাঁচানোর চেষ্টা করি। তখনো পুলিশ গুলি শুরু করেনি। এ সময় স্বৈরাচারের দোসর বেরোবির শিক্ষক আসাদ মন্ডল ও মশিয়ার রহমান, কর্মকর্তা আবুল কালাম, তাপস কুমার ঘোষ, কর্মচারী নুরুন্নবী, জনি ও নুর আলমসহ কয়েকজন শিক্ষার্থীদের প্রতি ইটপাটকেল ছোড়ে এবং গালাগাল করে। এ সময় সবাই সরে গেলেও আবু সাঈদ সরেননি। অতি কাছে থেকে পুলিশ সাঈদকে লক্ষ্য করে পরপর গুলি করতে থাকে। আবু সাঈদ লুটিয়ে পড়েন। অন্যান্য আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমিও তাকে সরিয়ে নেওয়ার সময় পুলিশ আবারও গুলি ছোড়ে। আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ৬০টি ছররা গুলি ঢোকে। আবু সাঈদকে অন্যান্য শিক্ষার্থী রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। এ সময় আমার পাশে থাকা শিক্ষার্থী আহমাদুল হক আলভী আমাকেও ওই হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমি সেখানে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ইতিমধ্যেই শহীদ হওয়া আমার ভাই আবু সাঈদের লাশসহ আরো ১৫/১৬ জন আহত শিক্ষার্থীকে দেখতে পাই। তখন আমি প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে নিরাপত্তাজনিত কারণে হাসপাতাল ত্যাগ করি। আবু সাঈদের বীরোচিত আত্মত্যাগ আমাদের আন্দোলন বেগবান করতে আরো সাহস জোগায়।’
বেরোবির বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সিএসই বিভাগের ছাত্র মো. রহমত আলী বলেন, ‘গত ১৬ জুলাই আবু সাঈদের শাহাদতবরণের পর ক্যাম্পাসে এক ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। শুরু থেকে আন্দোলনে সফল নেতৃত্বদানকারী আবু সাঈদ ভাইকে হারিয়ে তার অনুপস্থিতিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মাঝে কিছুটা মানসিক অবসাদ দেখা দেয়। পুলিশ, বেরোবি এবং মহানগর ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও তাদের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করে। ১৭ জুলাই আমরা অনেক ঝুঁকি নিয়ে ২ নম্বর গেটের কাছে শহীদ আবু সাঈদ ভাইয়ের গায়েবানা জানাজার ব্যবস্থাও তাতে অংশ নেই।
তিনি বলেন, ‘আবু সাঈদ ভাইয়ের শাহাদতবরণের পরে ওইদিনই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হলত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। বেরোবিসহ গোটা শহরে হাজারো ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশের গুলিতে অসংখ্য ছাত্র-জনতা আহত হন। এরপর ২০ জুলাই কারফিউ জারি করা হয়।’
রহমত বলেন, ‘আবু সাঈদের আত্মত্যাগ আমাদের উজ্জীবিত করেছে। আমরা সাক্ষাত মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই আন্দোলনে শরিক থাকি। আবু সাঈদের দেখানো পথে আমরা সাহসিকতার সঙ্গে আন্দোলন চালিয়ে যাই। আমরা রাজপথ ছাড়িনি। অবশেষে ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পলায়নের মাধ্যমে আমাদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। যার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে গিয়েছেন আবু সাঈদরা