অন্যদিকে সবচেয়ে কম বায়ুদূষণ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসসি মোড় এলাকায়, সেখানে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা পাওয়া গেছে প্রতি ঘনমিটারে ৮৮.৮৫ মাইক্রোগ্রাম, যা গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে কিছুটা বেশি। এ ছাড়া সবচেয়ে কম দূষণের তালিকায় ওপরের দিকে থাকা মৎস্য ভবন মোড়, সেগুনবাগিচা মোড়, শাহবাগ মোড় ও জিপিও মোড়ের মতো জায়গাগুলোতেও বাতাসে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় দুই গুণ বেশি ছিল।
জানতে চাইলে ক্যাপসের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ‘আমরা এই জরিপ কাজে দুটি জিনিস দেখেছি। একটি হলো তীব্র শীত বা শৈত্যপ্রবাহের মতো সময়ে বায়ুমান কেমন থাকে। আমরা সারা বছর দেখি যে দিনের তুলনায় রাতে বায়ুদূষণ বেশি থাকে। শীতের সময়ও এর কোনো পরিবর্তন হয়নি। রাতে বায়ুমান গড়ে আমরা ২৫০ থেকে ৩০০ মাইক্রোগ্রাম পেয়েছি, যেটা খুব আশঙ্কাজনক বিষয়। পিএম ২.৫ ৩০০ মাইক্রোগ্রাম থাকা মানে বায়ুমান সূচক ৪০০-এর ওপরে চলে যাওয়া। অর্থাৎ ঢাকার অনেক জায়গায় তীব্র শীতের সময় বায়ুমান দুর্যোগপূর্ণ ছিল।’
আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ‘যেসব এলাকার রাস্তায় সংযোগস্থল বেশি সেখানে বায়ুদূষণ বেশি। সংযোগস্থল বেশি হলে সেখানে যানজটও বেশি লক্ষ করেছি। অর্থাৎ যানজট যেখানে বেশি সেখানে বায়ুদূষণও বেশি। সে জন্য এসব সংযোগস্থলে ট্রাফিকব্যবস্থার উন্নয়ন করা খুব জরুরি, যার মাধ্যমে বায়ুদূষণ কমবে। আবার অনেক রাস্তায় যেখানে নির্মাণকাজ হচ্ছে, সেখানে নির্মাণকাজ ও যানজটের কারণে বায়ুদূষণও বেশি হচ্ছে।’
বিশ্বব্যাংক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এক যৌথ প্রতিবেদনে বায়ুদূষণের তিনটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো ইটভাটার ধোঁয়া ও ধুলা, যানবাহনের ধোঁয়া এবং নির্মাণকাজ থেকে সৃষ্ট দূষণ। তবে ক্যাপস বায়ুদূষণের ছয়টি কারণ চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো নির্মাণকাজ, ইটভাটা ও শিল্প-কারখানা, যানবাহনের ধোঁয়া, আন্তর্দেশীয় দূষণ (নেপাল ও ভারত থেকে আসা দূষিত বাতাস), রান্নাঘরের ধোঁয়া ও শহুরে বর্জ্য।
বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী, বায়ুমান সূচক ৫০-এর নিচে থাকলে তাকে ভালো বা বিশুদ্ধ বাতাস ধরা হয়। ৫১ থেকে ১০০-এর মধ্যে থাকলে সহনীয় বা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়। সূচক ১০১ থেকে ১৫০-এর মধ্যে হলে সতর্কতামূলক বা সংবেদনশীল মানুষের (শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তি) জন্য অস্বাস্থ্যকর ধরা হয়। ১৫১ থেকে ২০০ হলে সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর এবং সূচক ২০১ থেকে ৩০০ হলে বাতাসকে খুব অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। আর সূচক ৩০০ ছাড়ালে সেই বাতাস দুর্যোগপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
ক্যাপসের গবেষণা অনুযায়ী, রাজধানীতে শীতকালে বা শুষ্ক মৌসুমের পাঁচ মাসে (নভেম্বর-মার্চ) সারা বছরের প্রায় ৫৭ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। বর্ষা বা প্রাক-বর্ষাকালীন বাকি সাত মাসে ৪৩ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে।
ঢাকায় শীত মৌসুমে বায়ুদূষণ কিভাবে বাড়ে এবং তা আবহাওয়ায় কিভাবে ভূমিকা রাখে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ বলেন, ‘রাজধানীতে চলতি শীত মৌসুমে শৈত্যপ্রবাহ হয়নি। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীতকালে আমরা এখানে প্রচুর কুয়াশা ও ধোঁয়াশা দেখি। এর পেছনে বায়ুদূষণ বড় একটা কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, এর ফলে শৈত্যপ্রবাহ না থাকলেও দিনে তাপমাত্রা অনেক কমে যায়, যেহেতু সূর্যের আলো ভালোভাবে আসতে পারে না। ফলে শৈত্যপ্রবাহ না থাকলেও শীত বেশি অনুভূত হয়।’
চলতি বছর এখন পর্যন্ত বায়ুদূষণের সামগ্রিক চিত্র
ক্যাপসের গবেষণায় দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারির ২৮ দিনই ছিল ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ এবং তিন দিন ছিল ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর বা দুর্যোগপূর্ণ’ বায়ুমান। অন্যদিকে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার জানিয়েছে, চলতি মাসে গতকাল রবিবার পর্যন্ত ঢাকার মানুষ ১২ দিন ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ ও ছয় দিন অস্বাস্থ্যকর বাতাস সেবন করেছে।
ক্যাপসের আরেক গবেষণা থেকে জানা যায়, সর্বশেষ আট বছরের (২০১৬-২০২৩) মধ্যে ২০২৩ সালই সবচেয়ে দূষিত বছর। মূলত তিন বছর ধরেই বায়ুদূষণের গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী। ঢাকায় ২০২১ সালের গড় বায়ুমান সূচক ১৫৯; ২০২২ সালে ১৬৩ এবং ২০২৩ সালের গড় বায়ুমান সূচক ছিল ১৭১।
বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব জনস্বাস্থ্যে
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর বাংলাদেশে বায়ুদূষণজনিত রোগে ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, বায়ুদূষণের কারণে ঢাকার মানুষের গড় আয়ু কমছে সাড়ে সাত বছর।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক সেরাজুল ইসলাম বলেন, ‘বায়ুদূষণ বাংলাদেশে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ঢাকার চলমান উন্নয়ন ও নির্মাণকাজ, ইটভাটা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি থেকে নির্গত অ্যামোনিয়া, ক্রোমিয়াম ও ক্যাডমিয়ামের মতো রাসায়নিক জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে। সাময়িকভাবে এগুলো থেকে অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টসহ ফুসফুসের বিভিন্ন রোগ এবং দীর্ঘ মেয়াদে ক্যান্সারের মতো রোগ হতে পারে। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে আমরা লক্ষ করেছি বক্ষব্যাধি হাসপাতালে রোগী কিছুটা বেড়েছে।’
এদিকে ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য সরকারের উদাসীনতাকেই বড় করে দেখছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের (নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ) অধ্যাপক এবং ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ‘বায়ুদূষণ নিয়ে গণমাধ্যমে যেভাবে আলোচনা হয়েছে বা হচ্ছে সরকারি পর্যায়ে এই বিষয়টিকে ততটা উদ্বেগের জায়গায় চিন্তাই করা হয়নি। নির্মাণকাজে ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারি মেগাপ্রজেক্টে নির্মাণসামগ্রী বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখি উন্মুক্ত অবস্থায় থাকে। এখান থেকে বড় একটা দূষণ হচ্ছে। যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না থাকায় গাড়ির গতিতে উন্মুক্ত অবস্থায় থাকা নির্মাণসামগ্রী বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে আরো বেশি। সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সরেজমিনে তদারকি প্রায় অনুপস্থিত।
ঢাকার নির্মাণকাজ বা রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির সীমারেখা না টানতে পারলে এই শহরকে বাঁচানো যাবে না উল্লেখ করে আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘যে শহরে বায়ুমান এত খারাপ সে শহরে যদি এভাবে নির্মাণকাজ বছরের পর বছর চলতে থাকে তাহলে বায়ুমান নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ফলে সরকারি ও বেসরকারি খাতে আর কত নির্মাণকাজ অনুমোদন করা হবে তার জন্য একটি নীতিমালা হওয়া উচিত এখন। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড়ে বায়ুদূষণের তাত্ক্ষণিক অবস্থা দেখানোর ব্যবস্থা থাকা উচিত। ডিজেল বা পেট্রলচালিত গাড়ির মান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নগর এলাকায় ধীরে ধীরে সবুজায়ন কমে যাচ্ছে। সবুজায়ন বাড়াতে পারলে দীর্ঘ মেয়াদে আমরা বায়ুদূষণ একটা পর্যায় পর্যন্ত কমিয়ে আনতে পারব।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনার পরিচালক মো. জিয়াউল হক ঢাকার বায়ুদূষণের ভয়াবহ বাস্তবতা স্বীকার করে বলেন, ‘আমাদের বায়ুদূষণ, ধূলিদূষণ অনেক বেড়েছে। রাস্তার দূষণ এখন খালি চোখেই বোঝা যায়। আমরা অনেক চেষ্টা করছি যাতে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি যেন পরিকল্পিত ও সমন্বিতভাবে হয়। এটাও পুরোপুরি করা যাচ্ছে না। আমাদের পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ২০২২-এর আলোকে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটির দুটি সভা হয়েছে, যেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে নির্মাণ প্রকল্পগুলো যদি পরিবেশসম্মত না হয় এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও ঠিকাদার দায়ী থাকবে এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। এই নির্দেশনাগুলো সব জায়গায় পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের মাঠ পর্যায়ে প্রতিদিনই পরিবেশ অধিদপ্তরের ম্যাজিস্ট্রেট যাচ্ছেন এবং অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।’
জিয়াউল হক বলেন, ‘দু-এক দিনের মধ্যে আমরা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে স্বাস্থ্য সতর্কতামূলক বার্তা দেব। এ ছাড়া যেসব রাস্তায় বা এলাকায় দূষণ বেশি সেখানে আমরা বিলবোর্ড ও সরাসরি বায়ুদূষণের মাত্রা তুলে ধরব, যাতে জনগণ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে পারে।’
ব্যক্তি উদ্যোগে বায়ুদূষণ থেকে বাঁচার জন্য সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর জোর দিয়ে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক সেরাজুল ইসলাম বলেন, ‘করোনাকালে যখন মানুষ মাস্ক পরাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে চলেছে তখন শ্বাসকষ্টজনিত রোগ অনেক কমে এসেছিল। এই চর্চাটা বজায় রাখতে হবে। বাইরে গেলে সবাইকে ফেস মাস্ক পরতে হবে।’
সুত্র: কালের কণ্ঠ