আওয়ামী লীগের মহাসমাবেশ উপলক্ষ্যে রংপুর শহর ছিল লোকে লোকারণ্য। সড়কের কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কাছ থেকে একনজর দেখতে দলে দলে এসেছিলেন সবাই। রংপুর জিলা স্কুল মাঠ উপচে জনস্রোতের ঢেউ বয়ে যায় সড়কের অলিগলিতে। এত মানুষের ভিড়ে হুইলচেয়ারে ভর করে বদরগঞ্জ থেকে এসেছিলেন ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মজিবর রহমান মাস্টার।
জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত জনসমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে যেন তারুণ্যে ফিরেছিলেন ৯৫ বছর বয়সী মজিবর মাস্টার। ঘামঝরা ভ্যাপসা গরম উপেক্ষা করে তিনি পৌঁছেন সভামঞ্চে। বদরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি, সর্বজন শ্রদ্ধেয় সংগ্রামী এই বীর মুক্তিযোদ্ধা হুইলচেয়ারে সভামঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন। সেই মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও ছিলেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাসহ প্রভাবশালী মন্ত্রী ও এমপিরা।
বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়া মজিবর রহমান মাস্টার অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন মাঠভরা জনসমুদ্রের দিকে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের রণাঙ্গনের উত্তাল দিনগুলোতে ডুব দিয়েছিল তার মন। ভাবছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলার মাটি, মানুষের জন্য লড়াই করা দিনগুলোর কথা।
হঠাৎ বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এগিয়ে এসে মজিবর মাস্টারের সঙ্গে কথা বললেন। স্বভাবসুলভ আন্তরিকতায় তার হাত ধরে খোঁজখবর নেন। প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্যতায় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন মজিবুর রহমান। মাথায় হাত রেখে মন খুলে দোয়া করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে। সৃষ্টি হয় শ্রদ্ধা, সম্মান আর ভালোবাসার এক অনন্য নজির। লাখ লাখ জনতা তখন রাষ্ট্রপ্রধানের এমন উদার ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে জয় বাংলা স্লোগানে মুখর হয়ে উঠেন।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শ্রদ্ধা, সম্মান আর ভালোবাসার প্রদর্শনের অনন্য এই দৃশ্য এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল। ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মজিবর রহমান মাস্টার আবার যেন আলোচনায়। কারণ তিনি বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বহুবার দেখা করেছেন। জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গেও বেশ কয়েকবার দেখা ও কথা হয়েছে তার।
বুধবার (২ আগস্ট) সকালে যখন রংপুর জিলা স্কুল মাঠে আওয়ামী লীগের মহাসমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেখতে বদরগঞ্জ থেকে হুইলচেয়ারে ছুটে এসেছিলেন মজিবুর রহমান মাস্টার, তখন তার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহাসমাবেশকে সফল করার জন্য আমি এসেছি। আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, আমার কোনো কষ্ট নেই। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে আবারও শেখ হাসিনাকে দরকার।
মহাসমাবেশ শেষ করে রাতে বাড়ি ফিরে যান মজিবর রহমান মাস্টার। তিনি রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার কুতবপুর ইউনিয়নের খিয়ারপাড়া গ্রামের সেরাজ উদ্দিনের ছেলে। এ বছর বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘একুশে পদক-২০২৩’ পেয়েছেন তিনি।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে মোবাইল ফোনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মহাসমাবেশের সভামঞ্চে তাকে সম্মানিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন মজিবর রহমান মাস্টার। একইসঙ্গে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাসহ সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ভিশনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রচেষ্টার সফলতা কামনা করেন।
এই ভাষা সংগ্রামী বলেন, ১৯৫৫ সাল থেকে কয়েকবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়েছে। তারপর শেখ হাসিনার সঙ্গেও আমার অনেকবার দেখা হয়েছে। তাকে অন্তত ১৫-২০ বার দেখেছি। এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসেও ঢাকায় একুশে পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, কালকে (বুধবার) বিশাল জনসভায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমার এটাই অনুভূতি, যখন বিয়ে হয়নি তখন থেকেই বঙ্গবন্ধুকন্যাকে দেখছি। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও কয়েকবার দেখলাম। আমি আর হয়তো না-ও দেখতে পারি, এটাই আমার শেষ দেখা হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী আমার মেয়ের মতো, তাকে আমি কাছে পেয়ে দোয়া করে দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী যেন দেশ শাসনে ভালো করতে পারে। তার বাবার ডাকে যুদ্ধ করেছি, আজ বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী, এটাই তো আমাদের গর্ব।
মজিবর মাস্টার বলেন, আল্লাহর কাছে প্রধানমন্ত্রীর জন্য দোয়া করছি, তিনি যেন আরও ভালো কাজ করতে পারেন। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে যেন একটা উন্নত দেশে পরিণত করতে পারেন, এটাই আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ।
তিনি আরও বলেন, আমার একটা চাওয়া ছিল, সভামঞ্চে তাকে (প্রধানমন্ত্রী) বলেছি, ২০২৪ সালে যেন স্বাধীনতা পুরস্কার পেতে পারি। উনার (শেখ হাসিনা) হাতে একুশে পদক পেয়েছি, এখন এটাই চাওয়া। আর বাংলাদেশটা যেন সোনার বাংলা হয় এটাই সব সময় কামনা করি।
মজিবর রহমান মাস্টার মহান মুক্তিযুদ্ধে ৬ নম্বর সেক্টর থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন সংগ্রাম করায় তার নামে ওয়ারেন্ট হয়েছিল। ১৯৭১ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ভাষণের পর মজিবর রহমান মাস্টার বদরগঞ্জে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। তিনি ওই কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। আহ্বায়ক ছিলেন এমএলএ এলাহী বকস্ সরকার। পরবর্তীতে তাকে শ্যামপুর আঞ্চলিক সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক করা হয়েছিল।
মজিবর রহমান ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বদরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাকশাল গঠনের পর তিনি দীর্ঘদিন রংপুর জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এ ছাড়া তিনি বদরগঞ্জ শাখা টিসিসির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সে সময় তিনি বদরগঞ্জের কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও ছিলেন।
মজিবর রহমান মাস্টার স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর নেতা ও যুদ্ধাপরাধী এটিএম আজহারুল ইসলামের মামলায় সাক্ষী ছিলেন। তাকে বহুবার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। তা উপেক্ষা করেই তিনি সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ কারণে তিনি জামায়াত-শিবিরের হামলার শিকারও হন। মজিবর রহমান মাস্টারের গ্রামের পাশের গ্রামে এটিএম আজহারুল ইসলামের বাড়ি।