সংবিধান অনুসারে আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকার রয়েছে প্রতিটি নাগরিকের। তাই বিচারের আসায় সবাই আদালতের শরণাপন্ন হন। কিন্তু আদালত থেকে জামিনের পরও হয়রানিতে পড়তে হয় অনেক বিচারপ্রার্থীকে। এমনকি উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাওয়ার পারও হয়রানির শিকার হচ্ছেন কেউ কেউ।
গত ১৮ মে’র ঘটনা। পটুয়াখালী সদর থানা পুলিশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেওয়া কলেজ ছাত্র মো. আশরাফুল হাওলাদারকে আটক করে আদালতের পাঠানোর অভিযোগ ওঠে। ওইদিন রাতে আশরাফুলকে বাড়ি থেকে আটকের পর দিন ১৯ মে সকালে তাকে আদালতে পাঠানো হয়। এ সময় পুলিশকে হাইকোর্টের জামিনের কপি দেখানো হলেও তারা তা আমলে নেয়নি বলে দাবি আসামির পরিবারের।
আশরাফুলের পরিবারের অভিযোগ— আটকের পর পুলিশ মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। তা দিতে না পারায় পুলিশি ক্ষমতার বলে তাকে আদালতে পাঠানো হয়। যদিও হাইকোর্টের জামিননামা দেখে আসামিকে ছেড়ে দিয়েছেন পটুয়াখালীর চিফ জুডিশিয়াল আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট মো. জামাল হোসেন।
পত্রিকায় প্রকাশিত এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন গত ২১ মে উচ্চ আদালতের নজরে আনেন আইনজীবী আলী আহসান মোল্লা। সংবাদ প্রতিবেদনটি আমলে নিয়ে উচ্চ আদালত থেকে জামিনে থাকার পরও কলেজ শিক্ষার্থী মো. আশরাফুল হাওলাদারকে গ্রেফতারের ঘটনায় পটুয়াখালী সদর থানার ওসি মো. মনিরুজ্জামান ও এএসআই মিজানুর রহমানকে তলব করেছিলেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে জামিনে থাকা সত্ত্বেও উদ্দেশ্যমূলক গ্রেফতার করে বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করায় বিবাদীদের বিরুদ্ধে কেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন আদালত। বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলামের হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে লিখিতভাবে এ আদেশ দেন।
আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক হাজির হয়ে ওই ঘটনায় দুই পুলিশ কর্মকর্তা হাইকোর্টে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থণা করেন। তারা হলেন— পটুয়াখালী সদর থানার ওসি মো. মনিরুজ্জামান ও এএসআই মিজানুর রহমান। এ সময় আদালত বলেন, একের পর এক উচ্চ আদালতের আদেশ অমান্য করবেন। আর আমরা মাফ করে দেবো? এটা হতে পারে না। সংবিধান ও আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আদালতের আদেশ না মেনে জামিনে থাকা আসামিকে গ্রেফতারের ঘটনা ‘আদালত অবমাননা’ উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খাদেমুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং ৩১ অনুচ্ছেদ অনুসারে সবাই আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ আইন-আদালতের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করে চলেছে। তাদের এমন আচরণ আদালতের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখানোর মতো। আদালতের আদেশ সত্ত্বেও পুলিশের হস্তক্ষেপের কারণে ভুক্তভোগী ব্যক্তির অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। এটি সরাসরি আদালত অবমাননার শামিল। এ ধরনের ঘটনা আদালতের নজরে আনা উচিত এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। নয়তো দিন দিন এ ধরনের কর্মকাণ্ড বাড়তে থাকবে।’
এদিকে উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাওয়া কয়েকজন আসামি ও তাদের স্বজনদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে ৭২ লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। শরীয়তপুরের নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ ওঠে।
অভিযোগ আছে, শরীয়তপুরে জামিনপ্রাপ্তির পরও সাত আসামির মধ্যে ২ জনকে পুলিশ আটক করে। পরে তাদের নির্যাতনের মাধ্যমে ৭২ লাখ টাকা আদায় শেষে আদালতে সোপার্দ করা হয়। আর আদালত জামিনের তথ্য যাচাই-বাছাই না করে আসামিদের কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। ঘটনাটি উচ্চ আদালতের নজরে এলে আগামী ১৬ জুলাই পদ্মা সেতু দক্ষিণ থাকার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ মুস্তাফিজুর রহমান, শরীয়তপুর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির এবং শরীয়তপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে আদালতে হাজির হয়ে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে পুলিশের আইজি ও শরীয়তপুরের পুলিশ সুপারকে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে বলেছেন আদালত।
এভাবে বারবার উচ্চ আদালতের আদেশ অমান্য করাকে আইনবিরোধী কাজ হিসেবে দেখছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মজিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এ যেন পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে গেছে। পুলিশ হাইকোর্টের আদেশ মানছে না, যা খুশি স্বেচ্ছাচারিতা করছে। তারা আইনকে অবজ্ঞা করে চলেছে। কোনও অবস্থাতেই জামিনে থাকা আসামিকে গ্রেফতারের এখতিয়ার পুলিশের নেই। এ বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। নয়তো এক সময় আদালতের আদেশের ওপর থেকে বিচারপ্রার্থীদের আস্থা হারিয়ে যাবে।’