সোমবার, ১১ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:০৫ অপরাহ্ন

বর্তমান সংকট উত্তরণে প্রয়োজন সক্ষমতা, স্বচ্ছতা ও সদিচ্ছা

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট টাইম: মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২২
  • ১৩৬ বার পঠিত

বাংলাদেশে এখন যে চ্যালেঞ্জগুলো দেখা যাচ্ছে, এর মধ্যে কিছু চ্যালেঞ্জ তো কভিড-১৯-এর আগে এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগে থেকেই দেখা গেছে। যেমন—ব্যাংকিং খাত, রপ্তানি, শিক্ষা খাত, সম্পদ বণ্টন এবং সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার—এগুলো নিয়ে আমাদের কতগুলো সমস্যা ছিল। এগুলো আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। তারপর যোগ হয়েছে কভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।

এখন এই চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে বিভিন্ন কথাবার্তা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে, অর্থনীতিবিদ এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞ কথা বলছেন। সরকার থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পদক্ষেপগুলোর কিছুটা সুফল আমরা দেখছি। তবে একবারেই যে খুব দ্রুত পদক্ষেপগুলোর সুফল পাব, সেটা সম্ভব নয়। কতগুলো সমস্যা দীর্ঘকাল থেকে চলে আসছে। এই সমস্যাগুলো সমাধানে খুব দ্রুত কিছু বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। আমি বলব, সরকারি-kalerkanthoবেসরকারি খাতে যে নীতি-কৌশলগুলো আমরা নিচ্ছি, সেগুলো বাস্তবায়নে সক্ষমতা বৃদ্ধি করা দরকার। এটা না করলে যতই আমরা সিদ্ধান্ত নিই, পদক্ষেপ নিই—কোনো ফল হবে না।

দ্বিতীয়টি হলো স্বচ্ছতা। স্বচ্ছতা বলতে আমি বোঝাচ্ছি, এখানে কিন্তু অনেক রকমের ফাঁকফোকর রয়ে যাচ্ছে। কী হচ্ছে ব্যাপারগুলো, কোথায় সরকারের কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, বেসরকারি খাতে কী সমস্যা, সেগুলোর ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে এমনকি স্থানীয় পর্যায়ে সাধারণ মানুষের জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি, দরিদ্র লোকের আয় কমে গেছে; সে ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে—পদক্ষেপগুলোর ব্যাপারে কোনো স্বচ্ছতা নেই। লোকজন কিছু জানতে পারছে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি মনে করি, তিনটা জিনিস অত্যন্ত প্রয়োজন—সক্ষমতা, স্বচ্ছতা ও সদিচ্ছা।

সদিচ্ছাটা প্রয়োজন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যত পদক্ষেপ নেওয়া হোক, এমনকি সক্ষমতা যতটুকু তার ভেতরে সক্ষমতা বাড়ানোর পরও যদি জনকল্যাণে সরকার কোনো পদক্ষেপ নিতে চায়, সেটা কিন্তু সম্ভব হবে না যদি নীতিনির্ধারকদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও ভূমিকা না থাকে। এটা না থাকলে কিন্তু সব সময় সব কিছু আটকে যাবে। তো এই পরিপ্রেক্ষিতে এই তিনটা জিনিস সবচেয়ে বেশি দরকার।

এখন আসা যাক স্বচ্ছতা ও সক্ষমতার ব্যাপারে। আগে সক্ষমতার বিষয়টি বলা যাক। দেখবেন রেগুলেটরি বডিজ; যেগুলো নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বাংলাদেশ ব্যাংক, সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন, বিআরটিসি (বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন) সেগুলো যেভাবে চলছে, কাজ যেগুলো নেওয়া হচ্ছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে কিন্তু অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে। যারা এগুলো করবে তাদের কিছুটা হয়তো বোঝার সীমাবদ্ধতা আছে। এসব কাজ করতে গেলে যে অ্যাকশনগুলো নেওয়া দরকার, যে সহযোগিতা ও সমন্বয় দরকার সেগুলো পায় না। আলটিমেটলি যেটা হয়, সেটা যতই আমরা বলি, এটা করছি, সেটা করব; সেগুলো কিন্তু বাস্তবায়ন করা সবচেয়ে বড় ব্যাপার। প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন থেকে বড় বিষয় হচ্ছে আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো খুব দ্রুত মোকাবেলা করা।

আমাদের মতো অনেক উন্নয়নশীল দেশ রিফর্ম করেছে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এবং প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নত করার জন্য। এখানে শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কথাও আসবে। তাদের সক্ষমতা এবং এখানে যে সরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো আছে, এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো, বিডা (বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি), কম্পিটিশন কমিশন এদেরও কিন্তু যথেষ্ট সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তারা যদি সেটা না করে, তাহলে কিন্তু কোনোভাবেই সুফল হবে না।

তৃতীয়ত আসি স্বচ্ছতার ব্যাপারে। সবার ভেতরে যদি স্বচ্ছতা না থাকে তাহলেও সফলতা আসবে না। স্বচ্ছতা না থাকলে যেটা হয় সেটা হলো, যে সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয় সেগুলো জনগণের প্রয়োজন অনুসারে হচ্ছে কি না, তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন হচ্ছে কি না, অর্থের অপচয় হচ্ছে কি না, অর্থ সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করা যাবে না। এখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো দুর্নীতি। স্বচ্ছতা যদি না থাকে দুর্নীতি হবে। দুর্নীতি বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা। দুর্নীতি, অর্থপাচার, অন্যায়ভাবে অর্থ-সম্পদ কুক্ষিগত করা এটা হতেই থাকবে। দুর্নীতির কারণে ও স্বচ্ছতার অভাবে আমাদের অগ্রগতি পিছিয়ে যায়। সবচেয়ে বড় কথা হলো সম্পদ অপচয় হয়। এবং আলটিমেটলি যেকোনো প্রবৃদ্ধি আমাদের সাধারণ জনসাধারণের জন্য সুফল বয়ে আনবে না।

আর সদিচ্ছা না থাকলে কিছুই হয় না। সব কিছুরই মৌলিক বিষয় হলো রাজনৈতিক পরিবেশ, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা। আমরা অনেক সময় বলে থাকি যে সব আর্থ-সামাজিক সমস্যা, চ্যালেঞ্জের ঘনীভূত রূপের প্রতিফলন ঘটে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পরিবেশের ওপর। আর যদি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা না করতে পারি, সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা না করতে পারি, সেটারও প্রতিফলন ঘটবে রাজনৈতিকভাবে।

ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ-দুর্নীতি-অর্থের অপচয়, বড় বড় ঋণ নিয়ে সেটার সুষ্ঠু ব্যবহার না করা, ছোট ছোট খাতে বা যাঁরা মাঝারি ব্যবসায়ী, তাঁরা ঋণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম, ব্যাংকের পরিচালনার ক্ষেত্রে অনিয়ম আছে। এই সমস্যাগুলো কিন্তু মোটামুটি জানা। কিন্তু এসব সমস্যা সমাধানে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। মনে রাখা দরকার, সরকারি হোক, বেসরকারি হোক পৃথিবীর কোনো দেশে কোনো প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকতে পারে না। এটা স্বীকার করতে হবে যে রাজনীতি থাকবে। কিন্তু রাজনীতিটা এমন পর্যায়ে রাখতে হবে যে যেটা কার্যসম্পাদনে সহায়ক হয়। কর্মকর্তা, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোক্তা, তাদের কার্যকলাপ রাজনৈতিক বিবেচনায় হবে না, হবে প্রফেশনাল বিবেচনায়। অন্যান্য দেশেও কমবেশি এগুলো আছে। কিন্তু সেগুলো তারা রাজনৈতিক ইস্যুতে আলাপ-আলোচনা করে মোটামুটি একটা সহনীয় পর্যায়ে রেখেছে।

এখন সমস্যাগুলো জানা। আমাদের রপ্তানি অনেকটা কমে গেছে। আমদানি বেড়ে গেছে, রেমিট্যান্স কমছে; তার সঙ্গে যোগ হয়েছে সামাজিক কিছু সমস্যা। যেমন—দারিদ্র্য, স্বাস্থ্যের কতগুলো চ্যালেঞ্জ আছে। বিভিন্ন সেক্টরে বা খাতে, বিশেষ করে কৃষি খাত, ব্যাংকিং খাতের সমস্যাগুলো সুষ্ঠুভাবে নজরদারি বা সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, সেগুলো হচ্ছে না।

আরেকটা উদাহরণ হলো মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির অনেক কারণ আছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়া বা সরবরাহ কম হওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক কারণ আছে। আমরা যে জ্বালানি তেল আনি, সেটার দাম বেড়ে গেছে। সেগুলো আমাদের আওতার বাইরে। কিন্তু বাজারে যদি নিয়ন্ত্রণ না থাকে, যদি মনিটর করা না হয়, তাহলে ঝামেলা হবে। দেখা যায়, পণ্য গুদামে আছে, হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেছে। একেকটা পণ্য একেক সময় বাজার থেকে উধাও হচ্ছে। এখানে বাজারের স্বাভাবিক নিয়মগুলো পালন করা হয় না। এখানে নিশ্চয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা আছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থার ভূমিকা রাখতে হবে। কম্পিটিশন কমিশনেরও এখানে ভূমিকা আছে। সেগুলো না করে তো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া এবং টাকার অবমূল্যায়ন আমাদের একটি বড় সমস্যা। এর সমাধানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একক দায়িত্ব নয়, যদিও মুখ্য দায়িত্ব। এর জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন সহায়ক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করলেই আমরা সুফল পাব।

দেখা যাচ্ছে, ডিফল্ট লোন বাড়ানোর জন্য, পরিশোধ করার জন্য সময় বাড়ানো হচ্ছে, ডাউন পেমেন্ট করার জন্য সময় বাড়ানো হচ্ছে, প্রভিশনিংটা কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এগুলো কিন্তু আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী। এগুলো দিয়ে কিন্তু সমস্যার সমাধান করা যায় না। এগুলো দিয়ে ডিফল্ট বা একটা ভুল বার্তা পায়। তারা ভাবে আমাদের ঋণ পরিশোধ করার সময় বেড়ে গেছে। আর্থিক শৃঙ্খলা ও অন্য সব শৃঙ্খলার মাধ্যমে যে আইন আছে, সেগুলো প্রতিপালন করা যেতে পারে। এখানে সবচেয়ে বড় হলো সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা। এখানে এনবিআর আমরা যথেষ্ট দুর্বল। এগুলোতে যথেষ্ট নজর দিতে হবে।

লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

নিউজটি শেয়ার করুন..

  • Print
  • উত্তরা নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন:
এ জাতীয় আরো খবর..
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৩-২০২৩
themesba-lates1749691102