নির্মম এক ট্র্যাজেডির ভেতর থেকেও মানবতার অনন্য আলো ছড়িয়ে গেলেন মাইলস্টোন স্কুলের দুই শিক্ষিকা। আগুনের লেলিহান শিখার মাঝেও তারা নিজেদের জীবনকে তুচ্ছ করে ছুটে গেছেন শিক্ষার্থীদের পাশে। শিশুদের বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেরাই হয়েছেন আগুনে দগ্ধ, হার মানেননি দায়িত্ববোধ আর মমতায়। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা ছিলেন রক্ষাকবচ, সন্তানের মতো করে আগলে রেখেছিলেন শিক্ষার্থীদের।
জীবন দিয়ে জীবন বাঁচানোর এই মহৎ আত্মত্যাগ আজ ছুঁয়ে গেছে পুরো জাতিকে— গড়ে তুলেছে ভালোবাসা, ত্যাগ আর সাহসের এক অমর দৃষ্টান্ত।
গত ২১ জুলাই রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ীতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় দগ্ধ হয়েছিলেন দুই নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষিকা— মেহেরিন চৌধুরী ও মাসুকা বেগম নিপু। ঘটনাটি সারা দেশে পরিচিত হয়েছে ‘মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি’ নামে।
যা ঘটেছিল বিধ্বস্ত সেই দুপুরে
সেদিন স্কুলের ক্লাস প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। প্রতিদিনের মতোই নিজ কক্ষে দায়িত্ব পালন করছিলেন শিক্ষিকা মেহেরিন চৌধুরী। ঠিক তখনই আকাশে দেখা যায় বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানটি, যা হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে স্কুলের প্রাথমিক ভবনে বিধ্বস্ত হয়। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। আতঙ্কে ছুটোছুটি শুরু হয় পুরো এলাকাজুড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আগুন ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মেহেরিন চৌধুরী শিক্ষার্থীদের নিরাপদে বের করে আনতে ছুটে যান ক্লাসরুমে। ছোটদের ভয় না পেতে আশ্বস্ত করেন তিনি। একে একে ১৫-২০ জন শিক্ষার্থীকে নিজ হাতে গেট পার করিয়ে দেন। কিন্তু আগুনের বিস্তার এত দ্রুত হয় যে শেষ মুহূর্তে নিজে আর বের হয়ে আসতে পারেননি। তার শরীরে আগুন লেগে যায়, মুহূর্তেই দগ্ধ হন প্রায় শতভাগ।
বিমান বিধ্বস্তের সেই ভয়াল আগুনে প্রাণ হারান মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাইমারি শাখার আরেক শিক্ষিকা মাসুকা বেগম নিপু। ৮৫ শতাংশ দগ্ধ দেহ নিয়েও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়েছিলেন শিক্ষার্থীদের জন্য, যাদের তিনি নিজের সন্তান বলেই মনে করতেন। বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার সময় ক্লাসে ছিলেন মাসুকা বেগম। আগুন ছড়িয়ে পড়তেই আতঙ্কিত শিশুদের শান্ত করে একে একে বের করে আনেন তিনি। নিজের জীবন বাঁচানোর সময় ছিল, কিন্তু তিনি ফিরলেন না। ফিরলেন না যতক্ষণ শেষ বাচ্চাটিও নিরাপদে বেরিয়ে না যায়। এরই মধ্যে লেলিহান আগুনে জড়িয়ে নিঃশেষ হয়ে যায় তার শরীর।
সহকর্মীদের ভাষ্য, ‘ম্যাডাম পারতেন বাঁচতে, কিন্তু বাচ্চাদের ফেলে যাননি।’ পরদিন বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে বড় বোনের বাড়ির উঠানে তার দাফন সম্পন্ন হয়। নিঃসন্তান হলেও শত শত শিশুর ‘মা’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। জীবন দিয়ে তাদের জীবন বাঁচিয়ে গেছেন এক অনন্ত মমতায়, রেখে গেছেন ভালোবাসা আর আত্মত্যাগের এক অমর নজির।
শেষ কথায় যা বলেছিলেন ২ শিক্ষিকা
দগ্ধ অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে দ্রুত নেওয়া হয় জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। সেখানে লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার আগে স্বামী মনসুর হেলালকে কিছু কথা বলেছিলেন মেহেরিন চৌধুরী। পরবর্তীতে মনসুর হেলাল বলেন, ‘শেষ রাতে হাসপাতালে ওর সঙ্গে আমার শেষ দেখা। আইসিইউতে শুয়ে শুয়ে ও আমার হাত নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরেছিল। বলেছিল, আমার সঙ্গে আর দেখা হবে না। আমি ওর হাত ধরতে গিয়েছিলাম, কিন্তু শরীরটা এমনভাবে পুড়ে গিয়েছিল যে ঠিকভাবে ধরতেও পারিনি।’
তিনি বলেন, “আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি তোমার নিজের দুই সন্তানের কথা একবারও ভাবলে না? সে বলেছিল, ‘ওরাও তো আমার সন্তান। ওদের একা রেখে আমি কী করে চলে আসি?’ আমি আমার সবকিছু দিয়ে চেষ্টা করেছি ওকে বাঁচাতে, কিন্তু পারিনি। আমার দুইটা ছোট ছোট বাচ্চা এতিম হয়ে গেল।”
মেহেরিন চৌধুরী ছিলেন নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বগুলাগাড়ী রাজারহাট চৌধুরী পাড়ার মৃত মহিতুর রহমান চৌধুরীর মেয়ে। দুই সন্তানের জননী মেহেরিন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাতিজি ছিলেন। পরিবার নিয়ে ঢাকার উত্তরার একটি বাসায় বসবাস করতেন।
স্ত্রীবিয়োগের ব্যথা নিয়ে মনসুর হেলাল ওই সময় বলেছিলেন, ‘ও অনেক ভালো মানুষ ছিল। ওর ভেতরে একটা মায়া ছিল সবাইকে ঘিরে। আগুন লাগার পর যখন অন্যরা দৌড়াচ্ছিল, ও তখন বাচ্চাদের বের করে আনছিল। কয়েকজনকে বের করার পর আবার ফিরে গিয়েছিল বাকি বাচ্চাদের জন্য। সেই ফেরাটা আর শেষ হয়নি। সেখানেই আটকে পড়ে, সেখানেই পুড়ে যায় আমার মেহেরিন।’
অন্যদিকে, চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাশের বেডে থাকা আরেক শিক্ষককে নিজের শেষ ইচ্ছার কথা জানান দগ্ধ শিক্ষিকা মাসুকা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমি যদি না বাঁচি, আমাকে আমার বড় বোনের বাড়িতে দাফন করে দিও।’ তার ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পরদিন মঙ্গলবার সকালে তার মরদেহ হস্তান্তর করা হয় বড় বোন পাপড়ি রহমানের কাছে। বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে বোনের বাড়ির উঠানেই তাকে দাফন করা হয়।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে মাসুকা ছিলেন সবার ছোট। মা মারা গেছেন ১৫ বছর আগে। শিক্ষাজীবন শেষ করে প্রায় আট বছর আগে মাসুকা রাজধানীর একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তিন বছর আগে সেখান থেকে তিনি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুক্ত হন।
দুই শিক্ষিকার এক অনন্য দৃষ্টান্ত
মেহেরিন ও মাসুকা— দুই প্রজন্মের দুই শিক্ষক। কিন্তু হৃদয়ের স্পন্দন ছিল এক— দায়িত্ব, ভালোবাসা আর ত্যাগ। যখন চারদিকে আগুন, ধোঁয়া আর আতঙ্কের ছায়া, তখন তারা ছিলেন বাচ্চাদের আশ্রয়। আতঙ্কে যখন সবাই ছুটছিল বাঁচার পথে, তখন এই দুই নারী শিক্ষক দাঁড়িয়েছিলেন শিশুদের পাশে।
সেনাবাহিনীর উদ্ধার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দুই শিক্ষিকার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে অন্তত ৩০ জন শিক্ষার্থী প্রাণে বেঁচে গেছেন। তারা যদি শেষ মুহূর্তে সাহস না দেখাতেন, হতাহতের সংখ্যা আরও ভয়াবহ হতে পারত।
মাইলস্টোন কলেজের শিক্ষার্থীরা বলছেন, দুই শিক্ষকের হারানোর বেদনা, একই সঙ্গে শ্রদ্ধা ও গর্ব মিশে আছে তাদের হৃদয়ে। দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাফসান হোসেন বলেন, ‘আমরা ভাবতাম, শিক্ষক মানে শুধু ক্লাসে পড়ানো। কিন্তু মেহেরিন ম্যাম আর মাসুকা ম্যাম দেখিয়ে গেছেন, শিক্ষক মানে জীবন দিয়েও দায়িত্ব পালন করা। এখন প্রতিদিন স্কুলে এসে মনে হয়, এই জায়গাটাই তারা রক্ষা করেছেন। করিডোরে হাঁটলে মনে হয়, এখনই হয়তো ম্যামদের কণ্ঠস্বর শুনতে পাব।’
নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসনিয়া রহমান বলেন, ‘আগে কখনও ভাবিনি, আমার কোনো শিক্ষক এমনভাবে বীর হতে পারেন। আমরা আজও বুঝি না, কীভাবে কেউ নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে অন্যকে বাঁচাতে পারে। কিন্তু তারা দেখিয়ে গেছেন, শিক্ষকতা কেবল পেশা নয়— এটা ভালোবাসা আর আত্মত্যাগের নাম।’
তাদের এই আত্মত্যাগ নিঃস্বার্থ দায়িত্ববোধের প্রমাণ— উল্লেখ করে মাইলস্টোন কলেজের দিয়াবাড়ী ক্যাম্পাসের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জিয়াউল আলম বলেন, ‘মেহেরিন ও মাসুকা ছিলেন আমাদের প্রতিষ্ঠানের গর্ব, আমাদের পরিবারের প্রাণ। তারা ছিলেন শিক্ষার্থীদের মানসিক শক্তি, ভালোবাসার ভরসাস্থল। সেই শিক্ষার্থীদের রক্ষায় তারা শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত ছিলেন স্থির, দৃঢ় ও মানবিক। শিক্ষকতার আসল অর্থ এটাই— নিজের জীবন বাজি রেখে অন্যের জীবন রক্ষা করা।’
‘আমরা তাদের হারিয়েছি কিন্তু তাদের দেওয়া শিক্ষা ও উদাহরণ কোনোদিন হারাব না। মাইলস্টোনের প্রতিটি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক আজ তাদের ত্যাগের সামনে নত হয়ে আছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি দেয়ালে, প্রতিটি ক্লাসরুমে এখনও তাদের উপস্থিতি অনুভব করি। শিক্ষকতার মানে কী, দায়িত্বের শেষ সীমা কোথায়— তার উত্তর আজ মেহেরিন ও মাসুকা আমাদের দিয়ে গেছেন।’