নারী খৎনা যা নারী লিঙ্গাগ্রচ্ছেদ, নারী যৌনাঙ্গ বিকৃতকরণ, এবং নারী যৌনাঙ্গ ছাঁটাই নামেও পরিচিত; বলতে বোঝানো হয় সে সকল কার্যপ্রণালী যেগুলোতে স্ত্রী যৌনাঙ্গের আংশিক বা পুরোপুরি অপসারণ করা হয় অথবা সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বা অন্য কোনো চিকিৎসা বহির্ভূত কারণে নারীর যৌন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি করা হয় বা ক্ষত সৃষ্টি করা হয়। জাতিসঙ্ঘ বিশ্ব জনসংখ্যা তহবিল ৬ ফেব্র“ডয়ারিকে আর্ন্তজাতিক নারী যৌনাঙ্গ বিকৃতকরণ বিরোধী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে।
নারী যৌনাঙ্গ বিকৃতকরণ
১৯৯৬ সালে উগান্ডা ভিত্তিক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রক্রিয়াকরণ
কাটা-ছেড়ার সীমার উপর নির্ভর করে বিশ্বে বিভিন্ন রকম নারী খৎনার চর্চা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, অর্থাৎ যৌনাঙ্গের টিশ্যু কতো বেশি কেটে ফেলা হবে তার ওপর। প্রধানত চার ধরনের প্রক্রিয়া দ্বারা নারী খৎনাকে ভাগ করা হয়েছে। যদিও নারী খৎনার সকল প্রচলিত প্রক্রিয়াগুলো এই চারটি প্রক্রিয়াতে সন্নিবেশিত হয়েছে কিনা সে বিষয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে, সেই সাথে এই বিষয়গুলোর উপর দাখিল করা প্রতিবেদনের উপত্তের নির্ভরযোগ্যতা নিয়েও।
টাইপ ১
পুরো ভগাঙ্কুর বা ভগাঙ্কুরের অগ্রভাগ সম্পূর্ণ বা লম্বালম্বিভাবে কেটে অপসারণ করাকে টাইপ ১ নারী খৎনা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে; যা হুডেক্টোমি বা ক্লিটোরোডটোমি নামেও পরিচিত। ভগাঙ্কুরের অগ্রভাগ ও পুরুষাঙ্গের অগ্রত্বককে পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ ধরা হয়, যা খৎনার সময় কেটে ফেলা হয়। এখানে যে নারীরা লেবিডয়াপ্লাসটি করাতে ইচ্ছুক তারা ভগাঙ্কুরের অগ্রভাগ অপসারণের তীব্র বিরোধী কারণ এর ফলে ক্ষত সৃষ্টি ও স্নায়ুর ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে।
টাইপ ২
টাইপ ২ নারী খৎনাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে- ক্লাইটোরিসের সম্পূর্ণ অপসারণের সাথে লেবিডয়া মাইনরার আংশিক বা সম্পূর্ণ অপসারণ। এই ধরনের নারী খৎনাকে “খাফ্দ”-ও বলে, আরবিতে যার অর্থ “হ্রাস”।
টাইপ ৩ : অপসারণের সাথে ইনফিবুলেশন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা টাইপ ৩ নারী খৎনাকে কে সংজ্ঞায়িত করেছে যে, বর্হিযৌনাঙ্গের অংশ বিশেষ বা পুরো বর্হিযৌনাঙ্গের অপসারণ এবং যোনিদ্বারকে সেলাই বা চিকন করে ফেলা (ইনফিবুলেশন)। এটি নারী খৎনার সবচেয়ে মারাত্মক রূপ এবং জরিপে দেখা যায় এটি সকল নারী খৎনার প্রায় ১৫%। ইনফিবুলেশনকে ফারাওনিক খৎনা বা নামেও পরিচিত।
হর্ন অফ আফ্রিকাতে ইনফিবুলেশনের উপর এক পর্যবেক্ষণে, পিপডেয়টারস লক্ষ করেন এই প্রক্রিয়ায় বর্হিযৌনাঙ্গের বেশ অনেকখানি টিশ্যু কেটে ফেলা হয়, লেবিডয়া মেজরার ভেতরের অংশসহ পুরো লেবিডয়া মাইনরা। এরপর লেবিডয়া মেজরা কাঁটা বুনে বা সেলাই করে রাখা হয়। নড়াচড়া যেন না করতে পারে সেজন্য কিছু ক্ষেত্রে মেপডেয়টির দুই পা দুই থেকে ছয় সপ্তাহের জন্য বেধে রাখা হয়, যাতে তার ভালভার দুই পাশ সেরে ওঠে। পিউবিস থেকে মলদ্বার পর্যন্ত মাংস প্রাচীর ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না, সাথে শুধু ভালভার নিচের অংশে ছোট একটি জায়গা খোলা থাকে যাতে প্রস্রাব ও রজঃস্রাবের রক্ত বেরিয়ে যেতে পারে। সাধারণত এই কাজটি যিনি করেন তিনি এই প্রক্রিয়াটি করার ব্যাপারে অভিজ্ঞ ও প্রয়োজনীয় দক্ষতা সম্পন্ন, এবং এজন্য স্থানীয় চেতনানাশক ব্যবহৃত হয়। প্রতœন্ত অঞ্চলে যখন এই কাজটি করা হয়, তখন এটি সাধারণত করেন বয়স্ক মাতৃকা বা ধাত্রীরা এবং তখন কোন চেতনানাশক ব্যবহৃত হয় না।
যৌনমিলনের সময় বা কোন কাজের জন্য একটি উল্টো ইনফিবুলেশন সম্পাদিত হতে পারে। এই কাজটি করেন মহিলা আত্মীয়রা যাদের দায়িত্ব হলো ক্ষতটি কয়েক সপ্তাহ পর পর পরীক্ষা করা এবং যদি প্রয়োজন হয় তবে খোলা স্থানটি আরো একটু সম্প্রসারণ করা। শিশু প্রসবের সময় ঐ স্থানটি সাধারণ স্বাভাবিক প্রসব বা যোনিজ প্রসবের জন্য খুব ছোট হওয়ায় ইনফিবুলেশন সম্পূর্ণ খুলে ফেলা হয় এবং প্রসবের পর আবার লাগিয়ে ফেলা হয়। এবং আবার পা দুটো কিছু দিনের জন্য বেধে রাখা হয় যেন তাড়াতাড়ি সেরে ওঠে। যখন শিশু প্রসবের প্রক্রিয়াটি হাসপাতালে হয় তখন ডাক্তার শিশু প্রসবের জন্য ইনফিবুলেশটিকে ঠিক রেখে গভীর এপিসিপডেয়াটোমাইস-এর মাধ্যমে যোনিকে বড় করেন। পরবর্তীতে রোগীনী তার ভালভা আবার বন্ধ করে দেবার জন্য জোর করতে পারেন।
পর্যাপ্ত আধুনিক ওষুধ ও অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা না থাকায় এই চর্চাটির কারণে চিকিৎসা সংক্রান্ত জটিলতা বেড়েই চলেছে।
সুদানে ৩০০ জন নারী ও ১০০ জন পুরুষের মধ্যে পাঁচ বছর ব্যপী দেখা গিয়েছে যে নারীরা এই মারাত্মক যৌনাঙ্গ বিকৃতকরণের শিকার হয়েছিলেন তাদের মধ্যে বেশিরভাগ যৌনাকাঙক্ষা, সুখ এবং অর্গাজম বা শীর্ষসুখের অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন, এদতসত্ত্বেও তারা তাদের এই অনুভূতিগুলো তাদের সংস্কৃতিতে তারা লুকিয়ে রাখতে বাঁধ্য। এই প্রক্রিডয়াটির সমর্থকেরা এটি চালিয়ে যাবে কারণ তারা এটিকে আদর্শ সুন্দরের অনুগামীতা বলে মনে করে এবং এটি পশ্চিম থেকে অনেক আলাদা। অনেক ইনফিবুলেটেড নারী মত দেয়, এই প্রক্রিয়াটির কারণে তাদের সঙ্গীরা যে সুখ লাভ করবে তা সুনিদষ্টিভাবে একটি সফল বিবাহিত জীবন ও আনন্দপূর্ণ যৌন জীবনের অংশ।
টাইপ ৪ : অন্যান্য প্রক্রিয়া
অন্যান্য রূপগুলো যৌথভাবে টাইপ ৪ হিসেবে উল্লেখ্য এবং এটার সাথে কোন রকমের টিশ্যু অপসারন জডচঢ়ত নডয়। এটির সাথে বিভিন্ন সীমা চর্চার জডচঢ়ত, যেমন: ভগাঙ্কুরে সূচ ফোটানো, যৌনাঙ্গ পুডচঢ়পডেয় ফেলা ঘা সৃষ্টি করা সেই সাথে যোনি চিরে ফেলা অথবা যোনির ভিতরে তৃণলতা প্রবেশ করানো যাতে রক্ত পাত হয় এবং যোনিদ্বার চিকন হয়। টাইপ ৪-এর চর্চা প্রাথমিকভাবে কিছু বিচ্ছিন্ন নৃ-তাত্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায়, সেই সাথে অন্যান্য টাইপের সাথে একত্রেও দেখা যায়।
ব্যাপকতা
অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ধারণায় প্রতি বছর প্রায় ১৩০ মিলিডয়ন (১৩ কোটি) নারী এই নারী খৎনার কোন না কোনো একটি প্রক্রিয়া দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। বর্তমানে নারী যৌনাঙ্গ ছাটাই-এর চর্চা প্রধানত আফ্রিকান দেশগুলোতেই হয়। এটা একটি সাধারণ বলয় যার বিস্তৃতি পশ্চিম আফ্রিকার সেনেগাল থেকে পূর্ব উপকূলের ইথিওপিডয়া, সেই সাথে উত্তরে মিশর থেকে তানজানিয়া পর্যন্ত। এছাড়াও আরব উপদ্বীপের কিছু গোষ্ঠীর মধ্যেও এটির চর্চা দেখা যায়। যে সমস্ত দেশে নারী খৎনার ব্যাপকতা সবচেয়ে বেশি সেগুলো হলো মিশর, সেই সাথে সুদান, ইথিওপিডয়া ও মালি-তে। সাম্প্রতিক কালের সংখ্যাডয় ধারণা করা হয় ৯০% মিশরীয় নারী খৎনার শিকার হয়েছে। সম্প্রতি মিশর নারী খৎনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি আইন পাস করেছে।
নারী খৎনার চর্চা যখন আফ্রিকানদের মাঝে বিশ্বাসের জোরে প্রকাশ্যে ও ব্যাপকভাবে হচ্ছে, তখন মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অংশে এটির চর্চা হচ্ছে গোপনীয়তার সাথে। বিশেষ করে আরবদের মধ্যে (আফ্রিকান শিষ্টাচারসম্মত নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলো যারা ইনফিবুলেশনকে অধিকতর শ্রেডয় মনে করে) সাধারণত সুন্না লিঙ্গাগ্রচ্ছেদ বা খৎনা সম্পাদিত হডয়। চর্চাটি সাধারণত ঘটে থাকে বিশেষত উত্তর সউদি আরব, জর্ডান ও ইরাকে। সাম্প্রতিক কালে ইরাকের হাসিরা গ্রামের দেখা যায় যে, ৬০% নারী ও বালিকা বলেছেন যে তারা এই প্রক্রিডয়াটির শিকার হয়েছিলেন। সেখানে এই প্রক্রিয়াটির কোন শক্ত প্রমাণ পাওয়া যাডয় নি। সেখানে আরো কিছু আনুষঙ্গিক প্রমাণ আছে যা বলে, নারী খৎনার চর্চা সিরিয়া, পশ্চিম ইরান এবং তুরস্কেও আছে। ওমানে কিছু সমাজে এখনো নারী খৎনার চর্চা আছে; বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বিশ্বাস করেন এগুলোর সংখ্যা কম এবং তা বার্ষিকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সউদি আরবে এটির চর্চা মূলত সেসকল বিদেশী শ্রমিকদের মাঝে যারা পূর্ব আফ্রিকা ও নীল উপত্যকা থেকে এসেছে।
এটির চর্চা আরো আছে আমেরিকার কিছু নৃ-তাত্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে এবং খুব কম সংখ্যায় ভারতে (দাঊদি বহ্রা গোষ্ঠীতে)। ইন্দোনেশিডয়ার মুসলিম নারীদের মধ্যে মোটামুটি ভাবে এটির চর্চা খুব সাধারণ। অবশ্য আফ্রিকার সাথে তুলনা করলে প্রাডয় সবই টাইপ ১ ও ৪। ৪ নম্বর টাইপটি সাধারণত নির্দেশ করে প্রতীকীভাবে সূচ ফোটানোকে যা রক্ত বের করার জন্য করা হয়।
অভিবাসনের মাধ্যমে এটির চর্চা ইউরোপ, অস্ট্রেলিডয়া এবং আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। কিছু ঐতিহ্যমনা পরিবার তাদের মেয়েদের খৎনার ভেতর দিপয়ে যেতে হয় যখন তারা তাদের মাতৃভূমিতে ছুটিতে যায়। যেহেতু পশ্চিমা সরকার নারী খৎনার ব্যপারে খুব সচেতন, তাই তাদের আইনগুলো বহুদেশে নারী খৎনাকে আইনের লঙঘন হিসেবে সাব্যাস্ত করতে সাহায্য করেছে। খালিদ আদেম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ব্যক্তি যাকে ২০০৬ সালে তার কন্যাকে খৎনা করানোর জন্য শাস্তি প্রদান করা হয়।
সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় রূপ
ইসলাম ও খ্রিস্টান উভডয় ধর্মই ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক নারী খৎনার চর্চার শিকার। খ্রিস্টপূর্ব ১৬৩ অব্দের একটি গ্রিক প্যাপিরাসে উল্লেখ আছে যে, মিশরীয় মেয়েদের খৎনার ভিতর দিয়ে যেতে হতো এবং এটা ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে এটির জন্ম হয়েছিল ফারাওদের আমলে মিশর ও নীল উপত্যকায়। মমি থেকে প্রাপ্ত প্রমাণেও টাইপ ১ ও ৩ নারী খৎনা থাকার প্রমাণ মেলে। এখনো নারী খৎনার চর্চার বিস্তৃতি সম্মন্ধে কিছু জানা যায় না, তবে এই প্রক্রিডয়াটির চর্চা এখন মুসলিম, খ্রিস্টান ও সর্বপ্রাণবাদিদের মধ্যে আছে।
যদিও নারী খৎনার চর্চা কিছু বিশেষ ধর্মীয় উপ-সংস্কৃতিতে হয়, তারপরও প্রাথমিকভাবে নারী খৎনা ধর্মকে ছাপিয়ে একটি সাংস্কৃতিক চর্চা। ইউনিসেফ বলে যখন আমরা স্বাধীনভাবে ধর্মের দিকে তাকাই, তখন নারী খৎনার সাথে সাধারণত কোন সংশ্লিষ্টতা খুজে পাওয়া যাডয় না। ” নারী খৎনার যেসব যুক্তি ব্যবহৃত হয় তাদের মধ্যে হেরফের হয়, যুক্তিগুলো স্বাস্থ্য থেকে সামাজিক সুবিধা সম্পর্কিত বেশি।
পরিচ্ছন্নতা বজাডয় রাখা,সুস্বাস্থ্য বজাডয় রাখা,কুমারীত্ব অক্ষূণœ রাখা,উর্বরতাশক্তি বাচচানো,ঊচ্ছৃঙ্খলতা প্রতিরোধ করা,বৈবাহিক সুযোগ বৃদ্ধি পাওডয়া,নান্দনিকতার অনুসরণ,পুরুষের যৌনক্ষমতা ও সুখ বৃদ্ধি করা,সামাজিক ও রাজনৈতিক আসঞ্জনতার প্রবতন করা ।