দুপুর ১২টা। উত্তরা আজমপুর থেকে কমিশনারের অফিস উত্তরা কমিউনিটি সেন্টারে যাওয়ার রাস্তা। দুই পাশে চলছে ফুটপাথের মেরামত ও রাস্তা সম্প্রসারণ কাজ। এরই মাঝে রাস্তার অধিকাংশ জায়গাজুড়ে বিভিন্ন প্রকার মালামালের পরসা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। কেউ ফলের দোকান, কেউবা কাপড়ের দোকান। বাচ্চাদের খেলনার দোকানও রয়েছে। এসব দোকান ও ব্যাটারি চালিত অটো ও রিকশার কারণে রীতিমতো ভরদুপুরেও তৈরি হয়েছে যানজট।
পথচারীদের অভিযোগ, দুপুর গড়িয়ে বিকাল বা সন্ধ্যার সময় এ যানজট ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ফুটপাথ দখলমুক্ত করার ঘোষণা দিলেও খোদ কাউন্সিলরের অফিসে যাওয়ার রাস্তাতেই অস্থায়ী ও ভাসমান এসব দোকানের অবস্থা এটা। এছাড়া পুরো উত্তরা মডেল টাউন অঞ্চলের অবস্থা কোথাও এমন, আবার কোথাও এর চেয়েও নাজুক। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের উভয় পাশে মোট ১৪টি সেক্টর নিয়ে উত্তরা মডেল টাউন গঠিত। আর উত্তরা মডেল টাউন অঞ্চলের ১৪টি সেক্টর নিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তরের নবনির্ধারিত ১ নম্বর ওয়ার্ড গঠিত। আগেও এ অঞ্চল ১ নম্বর ওয়ার্ডেই ছিল।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, পুরো ১ নম্বর ওয়ার্ডের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। আগে রাস্তার ফুটপাথ দখল করে অস্থায়ী দোকান বসানো হতো। এখন শুধু ফুটপাথই না। তার সঙ্গে রাস্তার অংশজুড়েও ভ্যানগাড়ির ওপরে বসানো হয় এসব দোকান। আবাসিকের বিভিন্ন এলাকায় সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এসব দোকানের দেখা মেলে না। বিকাল শুরু হলেই তারা রাস্তার ওপরে ছোট ছোট এসব দোকানের পরসা সাজিয়ে বসেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব দোকানি সরকারি দল সমর্থিত বিভিন্ন নেতাকে প্রতিদিন চাঁদা দিয়ে এসব রাস্তার ওপর দোকানদারি করে থাকেন। আবার থানা পুলিশকেও দিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা। কথা হয় সাইদুল ইসলাম নামের এক কাপড় বিক্রেতার সঙ্গে। রাস্তার ওপরে বাঁশ পুঁতে ও চট বিছিয়ে পসরা সাজিয়েছেন কাপড় দোকানের। তিনি জানান, প্রতিদিন এই এলাকার সরকারি দলের এক নেতাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতে হয়। এছাড়া দুজন পুলিশ আসে। তাদের টাকা না দিলে দোকান উঠিয়ে দেয়। ওয়ার্ডজুড়ে ভাঙাচোরা রাস্তা, আবাসিক এলাকায় যানজট, গ্যাস-পানির অভাব ও মারাত্মক মশার উপদ্রবসহ নানাবিধ সমস্যা।
তবে কাউন্সিলর মো. আফসার উদ্দিনের দাবি, ঢাকার যে কোনো ওয়ার্ডের চেয়ে এ ওয়ার্ডের অবস্থা অনেক ভালো। কিছু সমস্যা আছে। সেগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। আশা করছি আগামী দুই বছরের মধ্যে উত্তরায় কোনো ভোগান্তি থাকবে না। উল্লেখ্য, সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডটি উত্তরা মডেল টাউনের অন্তর্ভুক্ত। ওয়ার্ডটির উত্তরে টঙ্গী ব্রিজ, পশ্চিমে হরিরামপুর ইউনিয়ন, পূর্বে দক্ষিণ খান ও দক্ষিণে এয়ারপোর্ট। সত্তর দশকের শেষদিকে উত্তরাকে মডেল টাউন কাম আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হয়। একে একে এই এলাকায় ১৪টি সেক্টর গড়ে ওঠে। আবাসিক এলাকা হলেও এই ওয়ার্ডে বহু বাণিজ্যিক ভবন গড়ে উঠেছে। এই ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত রবীন্দ্র সরণি, জসীমউদদীন এভিনিউ, গরীবে নেওয়াজ সরণি ও গাউসুল আজম রোডে গড়ে উঠেছে একাধিক বাণিজ্যিক ভবন। রয়েছে খেলার মাঠ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ।
সরেজমিন দেখা যায়, উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ১৩, ১৪, ১৫ ও ২০ নম্বর রোড, চৌরাস্তা এলাকার রাস্তা খুবই ভাঙাচোরা। ১২ নম্বর সেক্টরের ১৩ নম্বর রাস্তা, ১৩ নম্বর সেক্টরের ৫ ও ৭ নম্বর রাস্তা, ১৩ ও ১৪ নম্বর সেক্টরের চৌরাস্তা এলাকাও মারাত্মক ভাঙাচোরা। এর মধ্যে অনেক এলাকায় রাস্তা মেরামতের কাজ চলছে। তবে একেবারে মন্থরগতিতে কাজ চলায় নাগরিক ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। ১১ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা মো. শাজাহান আলী জানান, এসব ভাঙাচোরা রাস্তা এলাকায় রাত দিন সব সময়ই মারাত্মক যানজট লেগে থাকে। ধীরগতিতে কাজ চলায় সমস্যাটা আরও জটিল আকার ধারণ করছে। একসঙ্গে সব রাস্তার কাজ শুরু করে পুরো আবাসিক এলাকায় ভোগান্তি বাড়িয়ে তুলেছে। এছাড়া এসব এলাকার মধ্যে রয়েছে বড় বড় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিটা স্কুলের সামনেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লেগে থাকে যানজট। ১২ নম্বর সেক্টরের ১৫ নম্বর রোডের একটি বাড়ির বাসিন্দা ফরহাদ হোসেন জানান, ১১ নম্বরের ১৩ ও ১৪ নম্বর রাস্তার সংযোগ চৌরাস্তায় মাইলস্টোন স্কুল। ৭ নম্বরে অবস্থিত উত্তরা হাইস্কুল ও শান্তা মরিয়ম ইউনিভার্সিটি। এখানে সব সময় যানজট লেগে থাকে। স্কুল শুরু ও শেষের সময় সাধারণত কেউ সেদিকে যেতে চায় না।
রয়েছে গ্যাস ও পানির সমস্যা। ১৩ নম্বর সেক্টরের ৭ নম্বর রোডের জাহিদুল হাসান নামের এক বাসিন্দা জানান, প্রায়ই দেখা যায় লাইনে গ্যাস নেই। তখন সিলিন্ডার কিনে রান্না করা লাগে। একই সঙ্গে পানিরও সংকট রয়েছে পুরো উত্তরাজুড়ে। যখন লাইনে পানি থাকে না তখন ওয়াসার কাছ থেকে গাড়িতে করে পানি কিনে প্রয়োজন সারতে হয়। কিন্তু এটা কোনো সমাধান হতে পারে না।
এছাড়া অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উত্তরাজুড়ে মশার উপদ্রব অনেক বেশি। এ এলাকার ইসমাইল হোসেন অভিযোগ করে বলেন, নিয়মিত না করে মাঝে মাঝে ফগার মেশিন দিয়ে স্প্রে করে যায় সিটি করপোরেশনের লোকেরা। তাও আবার সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের চৌকি দেয়। যখন সিটি করপোরেশনের গাড়ি বা লোকজন দেখে তখন শব্দ করে মেশিন চালায়। আবার তারা চলে গেলে বসে থাকে। এছাড়া, উত্তরা আবাসিক কল্যাণ সমিতির সদস্য, নেতাদের বাড়ি ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের বাসা-বাড়ির আশপাশ এলাকায় গিয়ে স্প্রে করে। যাদের বাড়ির পাশে গিয়ে স্প্রে না করলে তাদের বিপদ হবে সেসব বাড়ির পাশে করে। কিন্তু সাধারণ এলাকায় স্প্রে করে মাঝে মাঝে। রয়েছে ময়লার স্তূপের সমস্যা। রাস্তার ওপরে ময়লা রাখার জায়গা। সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়িয়ে যায়। কিন্তু ময়লা নিতে গাড়ি আসে না। এমন অভিযোগ এখানের অনেক বাসিন্দা ও পথচারীর।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নির্বাচনের সময় সরকার দল সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী মো. আফসার উদ্দিনের দেয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে ছিল আধুনিক ও ভাঙাচোরা রাস্তামুক্ত প্লেন সিটি উপহার, পরিচ্ছন্ন নগর গড়ে তোলা ও লেক পরিষ্কার করাসহ সব ধরনের নাগরিক সুবিধার উন্নয়ন করা।
সিটি করপোরেশন নির্বাচন এতদিন গাড়ানোর পরও কোনোটারই এখন পর্যন্ত সমাধান করতে পারেননি স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরা। তবে কাউন্সিলর মো. আফসার উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, আগে বিদ্যুতের সমস্যা ছিল। এখন অতটা নেই। আগামী দুই বছরের মধ্যে উত্তরা একেবারে পরিচ্ছন্ন শহর হবে। যানজটের বিষয়ে তিনি বলেন, কিছু এলাকায় স্কুলের কারণে খুব যানজট লাগে। তবে এখানের যানজট নিরসনে আমরা অনওয়ে চালু করার কথা মাথায় রেখেছি। এছাড়া আবাসিক এলাকার মধ্যে অপরিকল্পিতভাবে স্কুল গড়ে উঠেছে। এগুলোকে এক জায়গায় আনার বিষয়েও চিন্তা রয়েছে আমাদের। তবে তিনি দাবি করেন, ঢাকার যে কোনো এলাকার চেয়ে আমাদের উত্তরা এলাকা অনেক ভালো চলছে।
রাস্তার ওপরে দোকান বসানোর বিষয়ে তিনি বলেন, কেউ যদি এমন চাঁদাবাজি বা অনিয়ম করে তাহলে তার দায় সাধারণত সরকারি দলের লোকজনের ওপরেই পড়ে। কিন্তু আসলে আমাদের কেউ এমন কাজ করছে না। যারা করছে তারা আমাদের নাম ভাঙিয়ে এগুলো করছে।